thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

আমার অভিজ্ঞতা

উচ্চশিক্ষার জন্য যখন জার্মানি যাবেন

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১৫ ০০:০৭:২৪
উচ্চশিক্ষার জন্য যখন জার্মানি যাবেন

রাশা বিনতে মহিউদ্দীন

উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অনেকেই দেশের বাইরে যেতে চান। তবে দেশের বাইরে যারা একা পড়তে আসবেন তাদের সব্যসাচী হতে হবে এটা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। মূলত দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির প্রয়োজন। প্রস্তুতির কোথাও ত্রুটি হলে সবকিছু কেঁচোগণ্ডূষ। তখন উচ্চশিক্ষা আশীর্বাদ না হয়ে বিপদও হতে পারে। তাই আগে থেকেই জেনেশুনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হওয়া ভালো।

জার্মানিতে খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি নেই। ফলে এখানে অনেক দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসেন। সেটা মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়া থেকে কেবল নয়, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও।

জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা মূল লক্ষ্য হলো— শুধু ইংরেজি দিয়ে চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু প্রফেশনাল চাকরি অসম্ভব। জার্মানিকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অব টেকনোলজি’। এখানে যাদের কম্পিউটার সায়েন্স, প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে প্যাশন আছে তাদের সম্ভাবনা খুব ভালো। সে ক্ষেত্রেও ভাষার দক্ষতা বি২ বা সি১ লাগবে।

ভারতে ছেলে-মেয়েদের স্কুল থেকে বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। তাদের একটা কম্পিউটার সায়েন্সের ব্যাচেলর ছাত্র অনেক আগে থেকে জার্মানি আসার পরিকল্পনা মাথায় রেখে প্রতি সেমিস্টারে জার্মান ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জনে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে। ব্যাচেলর পড়া চলাকালেই অনলাইনে জার্মানির চাকরির বাজার বাইন্টার্নশিপের খোঁজ নিজেকে সেই মাপকাঠি বা যোগ্যতা অনুযায়ী প্রস্তুত করে নিজেকে। তাই সরাসরি ব্যাচেলর করে ইন্টার্নশিপ শেষ করে চাকরির সুযোগও পেয়ে যান তারা মাস্টার্স না করেই। আবার জার্মান অনেক ছেলে-মেয়ে আউসবিন্ডুং করে চাকরি করে, আমরা যাকে আমাদের দেশে বলি ডিপ্লোমা। এদের অনেক লোক আউসবিন্ডুং করে যাদের উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার মতো এত মেধা নেই। দেশে যেমন গবেষক লাগে তেমনি শ্রমিকও লাগে। শতভাগ গবেষক বা শ্রমিক দিয়ে দেশ চালানো যায় না। তাই বিদেশে ডিপ্লোমা পড়ারও সুযোগ আছে। এখানে এক বছর ফ্রিতে কোনো বাসায় বাচ্চা দেখাশোনা করে মেয়েদের নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ আছে। এভাবেই নেপালে অনেক মেয়ে ভাষা শিখে এসে এখানে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা পড়ছে। আর মাস্টার্সে যারা আসেন তাদের ব্যাচেলর থেকে আগেই বি২ হয়ে গেলে এখানে এসে পার্টটাইম চাকরিও পেয়ে যান সহজে।

মনে রাখার বিষয়, কিছু বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলেও চাকরির সম্ভাবনা জার্মানিতে একেবারেই নেই ভাষা না জানলে। যেমন, সাংবাদিকতায় খুব ভালো সুযোগ-সুবিধা পড়াশোনার। কিন্তু সংবাদমাধ্যম হলো ভাষার খেলা। সেখানে ইংরেজি দিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা গেলেও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র খুব সীমিত। একই রকম আর্কিটেক্ট বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের বেলায়ও। ইংলিশ ও জিআরই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সুযোগ পাওয়া গেলেও জার্মানিতে জার্মান ভাষা লাগবে। আর যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে অনেক টিউশন ফি সে ক্ষেত্রে স্কলারশিপ আগেই ব্যবস্থা করতে হয়। কেননা, স্কলারশিপ খুব সীমিত তা-ও রেজাল্ট জিআরই বা আইইএলটিএস স্কোর মোটিভেশন প্রমাণে পাবলিকেশন লাগে স্কলারশিপ পেতে। তাই উচ্চশিক্ষা বিনা বেতনে জার্মানিতে হলে ভাষা জানা থাকলে অনেক দ্বার উন্মোচন হয়ে যায়।

মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের ছেলে-মেয়েদের জন্য বলব খুব ভালো করে জানার সুযোগ আছে এখানে। পরিবেশ নিয়ে জানতে হলে ইউরোপের গবেষণা রিসার্চ এখনো বিশ্বসেরা। এখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদেরও সারাদিন মেশিন নিয়ে বসে বসে শিখতে হয়। বিজনেসের ছেলে-মেয়েদের ব্যাচেলর পড়ার সময় বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ করতে হয়— যাতে বাস্তব জীবনে প্রয়োগে দক্ষতা ও যোগ্যতা গড়ে ওঠে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ নিয়ে মাঠে ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হয় হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য।

ইউরোপের ইউনিভার্সিটিগুলোতে শেখার অনেক সুযোগ রয়েছে সেটা পরবর্তী জীবনে কাজে লাগানো যায়। তবে এখানে ভাষা ছাড়া চাকরির সম্ভাবনা খুব কম। আবার যারা ব্যাচেলর করতে আসে ভাষা শিখে, পরে এদের চাকরি বা ক্যারিয়ার খুব ভালো করার সুযোগ আছে, কিন্তু শুরুটা তাদেরও খুব সহজ না। তাই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের ভাষা শেখা ও প্রস্তুতি শুরু করা উচিত স্কুল থেকে।

কারণ চাকরি বা পড়াশোনায় এখানে প্রতিযোগিতা সব দেশের ছেলে-মেয়েদের সাথে, যাদের আগে থেকে অনেক ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড বা বেসিক যেমন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও ছেলে-মেয়েরা জার্মানিতে আসে। আবার জার্মানি থেকে অন্য দেশে যারা যায়, তাদেরও অন্য ভাষার পরীক্ষা দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র হলে জিআরই বা ইউরোপের ফ্রান্স বা ব্রিটেন হলে ফ্রেঞ্চ ও ইংলিশ লাগে কেননা এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগ। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য উচ্চশিক্ষা গবেষণা সবকিছুতে ভাষার আদান-প্রদান খুব জরুরি। কেননা, একা একটা দেশ তার নিজের ভাষা নিয়ে এগোতে পারে না। ভাষা শেখা শুধু আমাদের দেশের জন্য না সারা বিশ্বের মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ। ব্রিটেনে স্কুলে শিশুদের ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষা শেখানো হয়। ভারতে বেশির ভাগ মানুষ কমপক্ষে দু-তিনটি ভাষা জানে।

প্রবাসে পড়াশোনা ও জীবন দেশের মতো রান্না, কাটাকাটি বা বাসন ধুয়ে দেওয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য কোনো কাজের বুয়া নেই। সব নিজেকেই করতে হয়, তা সে কোনো সোনার-চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো রাজকন্যা হোক বা কোনো অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে হোক। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হলে সে ডরমে থাকুক বা বাড়িতেই থাকুক রান্না, বাজার, ঘরদোর, বাথরুম, বেসিন, রান্নাঘর, ময়লার বালতি পরিষ্কার সবকিছু নিজেরই করতে হয়।

এখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমাদের দেশের মতো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় না যেখানে ক্লাসের ফাঁকে একটু খেয়ে নেওয়া যায়। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ভেবে নিতে হয় সকালে কী খেয়ে ক্লাসে যাবে, আর সে খাবারটা ঘরে আছে কি না? ঘুম ভেঙে ওভেনে বা টোস্টারে ব্রেড ঢুকিয়ে দিয়ে সাথে সাথে নিজের তৈরি হয়ে নিতে হয়। প্রবাসে সবকিছু ঠিক সময় মতো করতে পারা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে বাস, ট্রেন সব ঘড়ি ধরে চলে, এক মিনিট এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই।

আবার সারাদিনের জন্য বাইরে গেলে বা ক্লাসে থাকলে খাবার, কফির মগ, পানির বোতল সব ব্যাগে ভরে নিতে হয়। কেননা, চাইলেই রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চা খেয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। যেমন— আমাদের এত বড় ক্যাম্পাসে একটি মাত্র ক্যাণ্টিন রয়েছে। সেখানে দুপুরে খাবার ও চা-কফির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সে খাবার পয়সা দিয়ে শুধু কেনা হয়— আমি খুব ক্ষিধে নিয়েও পু্রোটা খেতে পারিনি কোনোদিন, এই এক বছরে।

আর ক্যাম্পাসে ওয়ান টাইম কাপ বা মগ অতিরিক্ত বর্জ্য তৈরি করে বলে একে খুব নিরুৎসাহিত করা হয়। তাই সবাই ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার আগে একটা ব্যাগপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে তাতে পানির বোতল, কফির মগ, জুস, চকলেট এবং সাথে দুপুরের খাবার ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ক্লাস, লাইব্রেরি, পড়াশোনা, পার্টটাইম কাজ সব করে ঘরে এসে আবার চলে পরের দিনের প্রস্তুতি। এখানে টানা ৪ ঘণ্টা করে ক্লাস দিনে ৮ ঘণ্টা বা তার বেশিও ক্লাস করতে হতে পারে যদি পাশাপাশি ভাষা শেখা বা অন্য কোনো ক্লাস থাকে। শহর-বাজার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোথাও রিকশা নেই, ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড় সবাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরে আর বাসস্টপ বা ট্রেন স্টেশনের পাশে সাইকেল রাখার ভালো ব্যবস্থা থাকে সব জায়গাতে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ঘরগুলোতে ইচ্ছেমতো ফার্নিচার, কার্পেট, সোফা বা নানা রকম পেন্টিং দিয়ে সাজানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ঘরে থাকার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার ঘর ধুয়েমুছে রং করে দিয়ে যেতে হয়। আমার জার্মানিতে গত অক্টোবরে এক বছর হলো। ডরমিটরিতে আমার ঘরের মেয়াদ শেষ হলো তখন আমাকেও ঘরে রং করে দিতে হয়েছে।

বিদেশে বাসা খুঁজে পাওয়া সে আরেক বিপদ। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম কীভাবে সব করব, একা ঘরের ফার্নিচার সাত-তলা আট-তলায় টেনে তোলা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। এখানে বন্ধুরা খুব সাহায্য করে। আমার ঘরের রং করা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমাকে ওরা বার বার জিজ্ঞেস করেছে কী সাহায্য লাগবে? একজন বন্ধু তো একা একা নিচ-তলা থেকে ছয়-তলা পর্যন্ত একটা ছোট ফ্রিজ টেনে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল। জার্মান মেয়েরা আমাকে বাসায় আবেদনপত্র লিখতে ও বাসা খুঁজে পেতে অনেক সাহায্য করেছে।

জার্মান ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখতে খুব শুকনো কাঠি কাঠি, রোগা-পাতলা দেখা গেলেও এদের কর্মক্ষমতা যে অনেক বেশি সেটা পার্ট-টাইম কাজ করতে গেলেই টের পাওয়া যায়। প্রথমদিকে খুব কষ্ট হতো আমার, এখন আস্তে আস্তে শিখে নিয়েছি অনেকটা এই এক বছরে।

এত দায়িত্ব আর ব্যস্ততার কথা আপনাদের শুনতে হয়তো খুব কঠিন মনে হচ্ছে, কিন্তু এগুলো আমাকে নিজের দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে। জার্মানিতে পড়তে এসে আমার মনে হয়েছে, এখানে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরিব সবাই সমান, সাদার উপরে কালো বা কালোর উপরে সাদার কোনো বৈষম্য নেই।

উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনা যে দেশেই হোক দেশে ফিরে আসা আর সেখানে চাকরি খোঁজা দু’রকম প্রস্তুতি লাগে। সুতরাং উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরির প্রত্যাশা থাকলে প্রস্তুতি হতে হবে স্কুল থেকে। সেটা ইউরোপ বা আমেরিকা যেটাই হোক। আইইএলটিএস-এ হুট করে ৭ পাওয়া যায় না বা জিআরই-এর কাঙ্ক্ষিত স্কোর পেতে লম্বা সময় প্রস্তুতি দরকার। তাহলে জেনে-বুঝে হোক প্রবাসে সফল উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার।

লেখিকা : জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব হোয়েনহেইম স্টুটগার্টে এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ফুড প্রডাকশন বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর