thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল 24, ১০ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৪ শাওয়াল 1445

আমি কি ভুলিতে পারি!

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ২৯ ১৫:১২:৫৪
আমি কি ভুলিতে পারি!

মো. আবুল কাসেম
ভাষার নামে দেশটির নাম বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বেড়ে যায়। তখন নানা কথায়, নানা লেখায় বাংলা ভাষার নানা খানা-খন্দ কিংবা প্রশস্তি চলতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ- বাংলা ভাষার ওপরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কমে যায়। শুধু কমেই না, ভাষাপ্রেমের হিস্যা তখন তলানিতে খুঁজতে হয়। অবশ্যই ইতোমধ্যে বাংলা ভাষায় অর্জনও যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তা স্বীকৃত। তবু কেন জানি, ভাষাপ্রেমের শতভাগ হিসাব মিলছে না। আমরা সবাই জানি, এদেশের মানুষ দ্রুত ভুলে, আবার দ্রুত জেগে ওঠে।

এখন থেকে শতাধিক বছর এমনকি ৬০/৭০ বছর পূর্বেও এ ভাষা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। ভাষাপ্রেমিক মনীষীরা এসব বিতর্ক নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে এ ভাষার মর্যাদা ও যথার্থ অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর নানা কূটকৌশলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই ভাষাকে ছোট করতে চেয়েছে। শুরুতেই তারা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় বাংলার ওপর আগ্রাসন চালায়। ভাষা প্রেমিক সাহিত্যজনেরা নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পীরাও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিরোধের দেয়াল তৈরি করেছেন। কতক সাংবাদিক, কতক পত্রিকা বাংলা ভাষার যথার্থ অবস্থান শিক্ষিত মহলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যখন শাসকগোষ্ঠীর কাছে তুচ্ছ হয়ে ওঠে তখনই ভাষার দাবি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক হাতিয়ার। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কণ্টআকীর্ণ পথ মাড়িয়ে এ ভাষা সকল বাঙালির দাবি হয়ে ওঠে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ পর্বে অগ্রগণ্য।

অবশেষে তুমুল আন্দোলন ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলা ভাষার স্থায়ী অস্তিত্ব। এই অস্তিত্বের প্রেরণা নিয়েই আরও রক্ত ও লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মাহুতির মাধ্যমে আমরা পাই স্বাধীন বাংলাদেশ। এসব ইতিহাস সবাই জানেন। কিন্তু কোথায় যেন অজানার সুর বাজে। সরিষায় ভূত বললেও অতুক্তি হয় না। ২০১৬ সালে যখন বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকতায় গৌরবোজ্জ্বল মাতৃভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষারও আবেদন-নিবেদন চলছে, তখনও এ ভাষার মানুষদের মধ্যে হীনম্মন্যতা থাকবে কেন? এখনও এদেশের ভাষাপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের কলম থেকে অসম্পূর্ণতার অপবাদ জুটবে কেন? এখনও এদেশে অন্যান্য আগ্রাসী ভাষার দাপটে বাংলা ভাষায় কালিমা পড়বে কেন? এইসব প্রশ্নবোধক দায়বদ্ধতা থেকে আমি নিজেকে নির্দোষ ভাবতে পারি না। তাই কিছু বলার এই স্বল্প প্রয়াস।

পত্রিকায় দেখা, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি এদেশে ‘বাংলিশ’ ব্যবহারে আক্ষেপও করেছেন। উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহারে দৈন্যদশার চিত্রও তুলে ধরেছেন।

ভাষা সৈনিক আহমদ রফিকও বাংলা ভাষার অসম্পূর্ণ প্রয়োগ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিষ্ট কামাল লোহানীও বাংলা ভাষার অপ-প্রয়োগ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগগুলো সত্য।

প্রশ্ন হলো- এসব দেখভালের দায়িত্ব কার? যাদের দায়িত্ব, তাদের ব্যর্থতার জন্য শাস্তি হবে না কেন? প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ভুল বানান ছাপা হচ্ছে। বাংলিশ উচ্চারণে বিনোদন অনুষ্ঠানসহ প্রচার-প্রচারণা চলছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ দোকানে-দোকানে ইংরেজির প্রাধান্য দেখা যায়। আবার ভুল বানানের সাইনবোর্ডগুলোও চোখে পড়ার মত। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছাপা দলিল দস্তাবেজেও অসংখ্য ভুল পাওয়া যায়। এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্য বইগুলোতেও বানান ভুলের নিদারুণ চিত্র চোখে পড়ে। এসব ভুল অনেকের কাছেই ছোট খাটো হতে পারে। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ও বৈশ্বিক স্বীকৃতিতে যে ভাষা ঋদ্ধ যে ভাষার এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন লাগামছাড়া ভুল কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জাতির কলঙ্ক হয়। সরকার অন্তত, ভাষার মাসে নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়। বিশ্ব ভাষার প্রতিযোগিতায় বাংলা আপন মহিমা হারায়।

এদেশে এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে বিতর্ক তৈরির জণ্য ফাঁক-ফোকর খোঁজার লোকের অভাব নেই। তাই বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেমের সাংবিধানিক সত্যের বাস্তবায়ন ঘটালেই বাংলা নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে এগুতে পারে। এদেশে এখন উন্নয়নের সহযোগী কার্পোরেট গোষ্ঠীর কার্যক্রম ও কানেটিভিটির দোহাই দিয়ে ইংরেজি ভাষাকেই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে সারাক্ষণ পাহারা দেয়া হয়। আবার বিশেষ শিক্ষার শিক্ষিত ধর্মান্ধ কতক শ্রেণিও বেহেশতি ভাষাকে বড় একটা জনগোষ্ঠীকে লোভাতুর করে তুলছে। এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েও এক মিশ্র ভাষা-ভাষী মানুষদের সহাবস্থান দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। তাতে মিশ্রভাষা সংস্কৃতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে বাংলা শিক্ষার লাভ শূন্যের কোঠায়। তাই বাংলার অপ-প্রয়োগে কিছু যায় আসে না।

এ অবস্থায় যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার আদর, কদর, লালন, পরিচর্যা ও প্রসার আমরা চাই কি না, সরকার চায় কি না, বাণিজ্যকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ চায় কি না। এ প্রসঙ্গে তাদের শিক্ষা আয়োজনে বাংলা শেখার সূচক প্রক্রিয়া জানা দরকার। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বাংলা শেখার চেয়ে ইংরেজির প্রাধান্য দেয়। শিক্ষকগণও বাংলা শেখার চেয়ে অন্যান্য বিষয় শেখাতে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও বাংলা পাঠদান কোন রকম শ্রেণি ডিঙানোর শিক্ষামাত্রা। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীগণ উচ্চ শিক্ষার জন্য কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারা ইংরেজিতে ফেলতো করেই বাংলা বিষয়েও ফেল করে অনেকে ছিটকে পড়ে।

দুর্ভাগ্য এখানেই শেষ নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যত্রতত্র অনার্স পড়ার সুবাদে যে কোন বিষয়ে পড়লেও ১০০ নম্বরের ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়। কিন্তু ১০০ নম্বরের ব্যবহারিক বাংলা শেখার কোন আয়োজন থাকে না। তাতে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বাংলা বিষয়ের দুর্বলতা কাটানোর আর কোন সুযোগ তারা পায় না। অথচ ক্যাডার সার্ভিসসহ যে কোন চাকুরী প্রার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ২০/২৫/৩৫ নম্বরের বাংলা প্রশ্নোত্তর করতে হয়। ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ৬০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২/৩টি বাদে কোনটিতেই বাংলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ নেই। তাদের কাছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণই মূল লক্ষ্য। অধিক টাকা উপার্জনের বিষয়কেই তারা আকর্ষণীয় করে প্রচার প্রচারণা চালায়।

প্রসঙ্গত বলা যায়- বুয়েট, মেডিক্যাল, টেকনিক্যাল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে বাংলা যা শিখেছিল -তা ভুলতে থাকে। তাছাড়া কারিকুলামগত কারণেই তাদের বাংলা মনে রাখার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

আমি মনে করি, মানবিক মূল্যবোধ জাগানিয়া, দেশপ্রেম জাগানিয়া বাংলা শিক্ষা সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য অপরিহার্য। যে কোন বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে মাতৃভাষার জ্ঞান থাকাও জরুরি। জাতীয় চেতনা শাণিত রাখার জন্য বাংলা জানা প্রয়োজন। এত প্রয়োজনের যে বিষয় বাংলা, তা সর্বশ্রেণি বা সর্বস্তরে পাঠ্য হবে না কেন? এ ভাষার বিশুদ্ধ ব্যবহার সর্বস্তরে নিশ্চিত হবে না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরটা এদেশের শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নকারীদের বিবেচনায় থাকা দরকার।

লোক দেখানো একুশের চেতনা উড়ানো মানুষেরা- ভিন্ন ভাষার পাগলপারা বণিকেরা দুঃখিনী বাংলার কষ্ট বুঝতে পারে না। সরকারও প্রহসনের ভাষাপ্রেম নিয়ে বর্ণমালার আর্তনাদে সমবেদনায় কেমন জানি চুপসে থাকে। তারাও বাংলা ভাষার জন্য গর্ববোধ করে, কিন্তু বাস্তবে চরম সত্যকে পরম ভাবতে পারে না। কথা এবং কাজে, আইন ও বাস্তবায়নে তাদের সদিচ্ছা থাকলে বাংলা ভাষার খানাখন্দ নিয়ে আজকে কারও কোন অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ থাকতো না।

সিলেটবাসী ভুল বানানের সাইনবোর্ড উঠানোর অভিযান চালাতে পারলে, সরকার সারাদেশে ২৪ ঘন্টায় ভুল বানানের সাইনবোর্ড উঠিয়ে দিতে পারে। দোকানসহ নানা প্রতিষ্ঠানের নামও বাংলা লেখাতে পারে। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মূল ফটকের ভুল বানানটিও শুদ্ধ করতে পারে। ডাক্তার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার, সামরিক বেসামরিক আমলারা যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, তখন আমার বলতে ইচ্ছে করে তারা বাংলা পড়েনি। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ যখন পাশবিকতায় মেতে ওঠে, তখন দৃঢ় চিত্তে বলতে ইচ্ছে করে তারা মানবিক বিদ্যা জানে না।

এখন সারাদেশে প্রায়ই হিংস্রতা বেড়ে যাওয়ায় উচ্চারিত হচ্ছে দেশে মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। নিজ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে কিংবা মানবিক শিক্ষায় পাঠদান কমে গেলে মানবিক মূল্যবোধ কমতেই পারে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বাদ দিয়ে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে রাখা অসম্ভব। নিজের ভাষা ও সাহিত্য পড়ার পথ মসৃণ করবেন না, উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লিখবেন না, উচ্চ শিক্ষায় বাংলার অবস্থান সুদৃঢ় করবেন না, বিজ্ঞান শিক্ষায় বাংলার আত্মীয়তা জোরালো করবেন না, আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি বিদ্যায় বাংলার প্রসার ঘটাবেন না আর একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে বলবেন, ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’

তখন যে কেউ বলতে পারে ১১ মাস তো ভুলেই ছিলেন, এই ১ মাস ভুললে এমন কী আসে যায়? সর্বনাশ! এ ভুল বাঙালি জাতীয়তাবাদী কোনজনই করতে পারে না। আসুন, আত্মজ বাংলাকে যে কোন ভুলের সীমানা ছাড়িয়ে কিংবা বৈষম্য দূর করে সর্বস্তরে সকলের আপন ভাষা করে নেই।

[মো. আবুল কাসেম, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ ওয়ালীনেওয়াজ খান কলেজ, কিশোরগঞ্জ]

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর