thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা

২০১৬ মার্চ ০৩ ০০:০৭:১৭
অসহযোগ আন্দোলনের ডাক, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা

আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী এদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারা পূর্ব বাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে চট্টগ্রাম, রংপুর ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সংঘর্ষ হয় এবং নির্বিচারে গুলি চালানো হয় জনগণের ওপর। এ সব ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক নিহত হয়।

এদিন ঢাকায় কারফিউ শিথিল করে সন্ধ্যার পরিবর্তে রাত ১০টা থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত বলবৎ করা হয়।

হরতাল চলাকালে ঢাকায় সকালের দিকে ‘সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ লাইন দখলে’র একটি গুজব দাবানলের মত শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর রক্ষার জন্য চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ এসে জড়ো হয়। পরে যখন জানা গেল এটা গুজব, তখন মানুষজন আস্তে আস্তে সরে যায়।

বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আগের দিন (২ মার্চ) রাতের গণহত্যার প্রতিবাদে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’র উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়।

বিকেলে পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আয়োজিত সমাবেশে ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এদিন এ সমাবেশ থেকেই ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণা করা হয়। এ অঞ্চলের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের স্বপ্নে লালিত দেশের আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ’ এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ -এ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করা হয়। স্বাধীনতার ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বলা যেতে পারে, এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সকল আনুষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সেদিন সম্পন্ন করা হয়েছিল।

অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে এ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলবে। কোন কর, খাজনা দেওয়া হবে না। অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে, কোন সহযোগিতা করা হবে না। ... ৭ মার্চের পূর্বে সামরিক সরকারের মত পরিবর্তন যদি না হয়, তবে ওই দিন ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।’

৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করে হরতাল পালনকারী গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করার জন্য বেলা ২টার পর রিকশাওয়ালাদের বেশি পয়সা দেওয়া এবং গুলির আঘাতে আহতদের চিকিৎসায় ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটে সংঘর্ষ কারফিউ জারি

হরতাল চলাকালে চট্টগ্রামে অবাঙালিদের লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে। হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিকাণ্ড ও গুলিবর্ষণে এদিন ৪ শতাধিক হতাহত হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারী জনতার ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। সারাদিন ধরে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ কলোনি, ওয়ারলেস কলোনি, আম বাগান ও পাহাড়তলীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে।

চট্টগ্রাম বন্দরে আগত জাহাজ এমভি সোয়াদ থেকে সৈন্য ও গোলা-বারুদ নামানোর সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও নাবিকদের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক শ্রমিক নিহত হয়। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর একটি ইউনিট এ সময় বাঙালি শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে রংপুর ও সিলেটে কারফিউ জারি করা হয়। রংপুরে এদিন দুপুর আড়াইটা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত এবং সিলেটে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়।

ভুট্টোর বক্তব্যের জবাবে বঙ্গবন্ধু

আগের দিন (২ মার্চ) ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে এক সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রাখেন এর জবাবে বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানের সমাবেশে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করেন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।’

ইয়াহিয়ার প্রস্তাব শেখ মুজিবের প্রত্যাখ্যান

রাওয়ালপিন্ডির রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে এক বেতার বার্তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের ১২জন নেতাকে ১০ মার্চ ঢাকায় বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। এরা হলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, খান আবদুল কাইয়ুম, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, মওলানা মুফতি মাহমুদ, খান বাহাদুর ওয়ালী খান, মওলানা শাহ আহমাদ নুরানী, আবদুল গফুর আহমেদ, মোহাম্মদ জামাল কোরেফা, নূরুল আমীন, মেজর জেনারেল জামালদার ও মালিক জাহাঙ্গীর খান।

ইয়াহিয়ার এ প্রস্তাবকে ‘নির্দয় তামাসা’ হিসেবে উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যখন নিরস্ত্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে, শহীদদের তাজা খুন যখন রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, নিহত ব্যক্তির লাশ তখনও দাফন করা হয়নি, শত শত আহত ব্যক্তি যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করছে, ঠিক সেই সময় ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলনে বসার জন্য বেতার ঘোষণা মারফত আমন্ত্রণের প্রস্তাব একটি নির্দয় তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়।’

বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রয়েছে, কঠোর অস্ত্রের ভাষার ধ্বনি আমাদের কানের কাছে ধ্বনিত হচ্ছে -এই অবস্থায় সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো বস্তুতপক্ষে বন্দুকের মুখে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। এই অবস্থায় এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

গ্রন্থনা : সোহেল রহমান

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এনআই/মার্চ ০৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর