thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৭ শাওয়াল 1445

মানবতায় নিবেদিতপ্রাণ সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা

২০১৬ মার্চ ০৭ ২১:২১:৫৫
মানবতায় নিবেদিতপ্রাণ সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা

সাইফুল ইসলাম শিল্পী, চট্টগ্রাম : গত দুই বছরে প্রায় দুই শতাধিক নারী ও শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা বেগম। মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন অন্তত অর্ধশত শিশুকে। সহযোগী কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছেন আরও অর্ধশতাধিক শিশুকে।

গত এক বছরে তথা ২০১৫ সালে প্রায় ২০০ নির্যাতিত নারীকে আইনি সহযোগিতা ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা এই নারী কর্মকর্তা দেশের প্রয়োজনে হাসতে হাসতে মরতেও প্রস্তুত।

মাহমুদা বেগম; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করা এক নারী। ব্যক্তিজীবনে এক সন্তানের মা। কুমিল্লার তিতাসে পৈত্রিক বাড়ি হলেও বাবার চাকরি সূত্রে জন্ম চট্টগ্রামে। পরে কর্ণফুলীর তীর বন্দর নগরী চট্টগ্রামেই বেড়ে ওঠা তার। বাবা এ এফ এম জাহিদুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা নিলুফা বেগম গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনিই বড়।

পড়ালেখা শেষ করে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ২৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন তিনি।

আলাপকালে মাহমুদা দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ব্যাচে নির্বাচিত হয়ে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম যখন, তখন প্রকাশিত হয় ২৯তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল। ওখানেও কাস্টমস ক্যাডারে নির্বাচিত হন তিনি। পড়ে যান দো-টানায়। কোনটা বেছে নেবেন? পুলিশ ক্যাডার নাকি কাস্টমস ক্যাডার? সমাজ, সংসার ঠিক রেখে কোনোপ্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়া নীরবে-নিভৃতে চাকরি করে জীবন ধারণের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে কাস্টমস ক্যাডারে। আর পুলিশ ক্যাডারের মাধ্যমে সরাসরি সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসা যায়। সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশ ক্যাডারেই থাকবেন। অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে কাস্টমসের চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশই উপযুক্ত জায়গা বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো আমি এখন বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত একজন সদস্য। কাস্টমস বিভাগে যোগদান করলে হয়তো মানুষের খুব কাছাকাছি থাকার এ সুবর্ণ সুযোগ পেতাম না।’

মাহমুদা বলেন, ‘পুলিশের পোশাক পরেও বঞ্চিত নারী-শিশুদের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমাকে এ পোশাকে দেখে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বেশি অনুপ্রাণিত হয়।’

কাজ করতে গিয়ে পুলিশ হিসেবে যতটা সফল ততটা সফল একজন নারী হিসেবেও। নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হননি তিনি। বলেন, ‘এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায় মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। ট্রাফিক পুলিশে দায়িত্ব পালনকালীন যখন পোশাক পরে রাস্তায় নামতাম তখন সবাই ইতিবাচকভাবে, আগ্রহ নিয়ে সহযোগিতা করতেন।’

এ কারণে পোশাকটা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে মনে-প্রাণে গ্রহণও করেছেন তিনি। নিজেকে গড়ে তুলেছেন একটু ব্যতিক্রমভাবে। তিনি বলেন, ২৭ এপ্রিল ২০১৫; সিএমপির কোতোয়ালি থানা এলাকায় জুয়েল হোসেন নামে আট বছরের এক শিশুকে খুঁজে পায় পথচারীরা। পরে কোতোয়ালি থানা পুলিশের মাধ্যমে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে আসা হয় শিশুটিকে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় জুয়েলের চিকিৎসা করানো হয়। জানা যায়, ভারতের আগরতলার সুনামুরা থানার বাসিন্দা জুয়েল। বাংলাদেশে অবস্থানরত কুমিল্লার নানুর বাড়িতে বেড়াতে এসে হারিয়ে যায় সে। ব্যস, এতটুকুই ইনফরমেশন ছিল পুলিশের হাতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রযুক্তির সহায়তায় জোগাড় করা হয় সুনামুরা থানার ফোন নাম্বার। যোগাযোগ করা হয় ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে। তাদের সহযোগিতায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সুনামুরার অজপাড়াগাঁ থেকে জুয়েলের মা-বাবাকে খুঁজে বের করা হয়। এরপর কিছু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় আট দিন পর বিজিবি ও বিএসএফের সহায়তায় সুনামুরা থানা পুলিশের মাধ্যমে জুয়েলকে বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি পড়ার সময় সহজ মনে হলেও কাজটি করা ছিল বেশ কঠিন। কিন্তু সেটি সেদিন সম্ভব হয়েছে শুধু মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে।

শুধু জুয়েল নয়, হারিয়ে যাওয়া এমন অর্ধশতাধিক শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসি, ট্রাফিক হিসেবে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগে যোগ দেন । একই সঙ্গে দায়িত্ব নেন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেরও। গত দুই বছরে প্রায় দুই শতাধিক নারী ও শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে মাহমুদা বেগম অংশ নিয়েছেন আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় সোয়াত প্রশিক্ষণে।

মাত্র ১৪ জন নারী নিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে নারী সদস্যদের যাত্রা শুরু হয়। সাতজন মহিলা কনস্টেবল এবং সাতজন এসআই নিয়োগ দেওয়া হয় তখন। ১৯৮৪ সালে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম বিসিএস পুলিশ ক্যাডার ফাতেমা বেগম (বর্তমানে ডিআইজি)। ২০১৩ সালে এসে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে ক্রাইসিস রেসপন্স টিম ‘সোয়াত’-এ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান মাহমুদা বেগম।

তিনি বলেন, ‘সোয়াতের ট্রেনিং সেন্টারে প্রথম যখন শরীরে ৩০ কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ বডি আরমার (ভোস্ট) জড়িয়ে দেওয়া হলো তখন মরি-মরি অবস্থা। সেই বডি আরমার পরে অস্ত্র হাতে যখন ফিল্ডে নামলাম তখন আমার মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতির জন্ম হলো। আমি নারী থেকে হয়ে উঠলাম মানুষ। একজন যোদ্ধা, বাঙালি যোদ্ধা, বাংলাদেশি যোদ্ধা।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভালোই লাগছে এখন। যদিও ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয় তবুও আমি বিশ্বাস করি- কর্মই ধর্ম।’ হাসতে হাসতে বলেন, ‘কর্ম ছাড়াতো মানুষের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব। জাতির দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছি। বিপদকে কখনো ভয় করি না। প্রয়োজনে দেশের জন্য হাসতে হাসতে মরতে পারব।’

মাহমুদা জানান, শুধু পেশায় নয়, একজন স্ত্রী বা গৃহিণী হিসেবেও তিনি সফল। সংসার জীবনে সাংবাদিক স্বামী আর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তিনি খুবই খুশি। সংসার একটি ‘টিম ওয়ার্ক’ বলে মনে করেন তিনি। তার কর্মগুরুত্ব ও ব্যস্ততা দুটোকেই তার স্বামী ও সন্তান ইতিবাচকভাবে দেখেন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বর্তমানে কঙ্গোতে মিশনে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছেন।

(দ্য রিপোর্ট/এমএআর/এম/মার্চ ০৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর