thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

ইউরোপের পথেঘাটে ছড়িয়ে দিতে চাই বাংলা গানের সুর : কুমকুম

২০১৬ মার্চ ০৭ ২১:৩৪:৫৫
ইউরোপের পথেঘাটে ছড়িয়ে দিতে চাই বাংলা গানের সুর : কুমকুম

মাসুম আওয়াল, দ্য রিপোর্ট : ‘গানটা আসলে অনুভবের ব্যাপার। তারা আমাদের ভাষা বোঝে না, এরপরও আমাদের গান শুনছে। এটা আমাদের সুরের শক্তি। আমাদের সাথে যখন বিদেশিরা আমাদের বাংলা ভাষাতে গান গায়। তখন মনের মধ্যে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে।’― কথাগুলো বলছিলেন প্যারিস প্রবাসী কণ্ঠশিল্পী জেসমিন আনার কুমকুম।

প্রায় দুই যুগ ধরে ফ্রান্সে বসবাস করছেন তিনি আর তার সঙ্গীত পরিচালক জীবনসঙ্গী আরিফ রানা। সম্প্রতি বাংলাদেশ এসেছেন তারা। সম্প্রতি ঘুরে গেছেন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের কার্যালয় থেকে। নারী দিবসের আয়োজনে প্রকাশিত হচ্ছে প্রবাসী কণ্ঠশিল্পী কুমকুমের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।

দেশে এসেছেন কবে?

বাংলাদেশে এসেছি এক সপ্তাহের মতো হলো। আমার আগেই আরিফ রানা দেশে এসেছে। আমি এসেছি পরে। ১৯ মার্চ পর্যন্ত দেশে থাকব। হাতে কিছু কাজ নিয়ে এসেছি। এর মধ্যেই সব কাজ শেষ করে যাব।

কী কাজ নিয়ে দেশে আসা?

আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার ও আমার জীবনসঙ্গী আরিফ রানা দুজনের দুটো অ্যালবাম প্রকাশ করা। প্রধানকাজ এগুলোই।

আপনার অ্যালবামটি প্রসঙ্গে বলুন...

এটা আমার প্রথম একক অ্যালবাম। নাম রেখেছি ‘আমার আমি’। অ্যালবামটির সব গান আমি নিজেই লিখেছি, সুর করেছি। আর সঙ্গীত আয়োজন করেছেন আরিফ রানা। প্যারিসেই পুরো অ্যালবামের কাজ শেষ করেছি। এর মধ্যে জি-সিরিজের সঙ্গে কথা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৯ মার্চের মধ্যেই বাজারে আসবে অ্যালবামটি।

অডিওর পাশাপাশি মিউজিক ভিডিও কি প্রকাশ করছেন?

গান এখন শোনার পাশাপাশি দেখার বিষয়ও হয়ে গেছে। আমি প্রথমত মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করতে চাইনি। অ্যালবামের প্রকাশকও চান মিউজিক ভিডিও করি। তাই আপাতত একটি গানের মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।

ফ্রান্সে থাকছেন অনেক দিন হলো। ওখানে সাধারণত কোথায় কোথায় হয় আপনাদের কনসার্টগুলো?

আমি ১৯৮৭ সাল থেকেই ফ্রান্সে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির যেই সব অনুষ্ঠান হয়, সেই সব অনুষ্ঠানে গান গেয়ে আসছি। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, পয়লা বৈশাখ এই রকম বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলা গান করে থাকি। এরপরও ফ্রেঞ্চ কমিউনিটি, শ্রীলঙ্কান কমিউনিটি, আরবি কমিউনিটিতে গান করে থাকি। সেখানেও বাংলা গানই করি।

বাংলা গানকে বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন?

ইউরোপের পথেঘাটে ছড়িয়ে দিতে চাই বাংলা গানের সুর। ফ্রান্স ছাড়াও আরও অনেকগুলো দেশে আমি আর আমার স্বামী আরিফ রানা গান করেছি। আলজেরিয়াতে গিয়েও বাংলা গান করে এসেছি। আলজেরিয়ার শিল্পী জায়েদ ওর সঙ্গে একটি অ্যালবামেও দুটো গানে কণ্ঠ দিয়েছি। ফ্রান্সের বিভিন্ন শপে পাওয়া যায় অ্যালবামটি। মজার ব্যাপার হলো গানগুলো ছিল বাংলা গান। আমরা চেষ্টা করছি বাংলা গানটিকে ছড়িয়ে দেওয়ার।

আপনার সঙ্গীত চর্চার শুরুর গল্পটি শুনতে চাই...

গানের সঙ্গে ভালোবাসা ছোট থেকেই। তবে দেশে সেইভাবে গান শেখা হয়নি। ১৯৮৬ সালে আমি প্যারিসে চলে যাই। এক বছর পরে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ থেকে একটি হারমনি নিয়ে যাই। এরপর গান শেখা শুরু হয়। এরপর নিজে নিজেই গান শেখা শুরু করি। তবে আমার গানের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা যার, তিনি হলেন আরিফ রানা। তার কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। তার কারণেই আমার এত দূর আসা। প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশ করা হচ্ছে তার কারণেই।

ফ্রান্সে বাংলা গানের বর্তমান অবস্থা কেমন?

আগে এমন একটা অবস্থা ছিল বাংলাদেশ নামে যে একটা দেশ আছে সেটা সেখানকার লোকজন জানত না। কখনো আমরা দেশের পরিচয় দিলে তারা বলত.. ‘ওই দেশের কথা বলছ যেখানে বন্যা হয়!’ ওখানে আমাদের দেশের যারা যে অঙ্গনে কাজ করেন তারা তাদের অঙ্গনে থেকে নিজের দেশকে পরিচয় করানো কাজটি করতে পারেন। আমি শিল্পী হিসেবে আমাদের সঙ্গীতকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমরা যখন গান গাই- বিশেষ করে ফোক, লোকগান, ময়মনসিংহ গীতিকা, হাছনের গান, লালনগীতি, তখন সেই গানের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করি। গান শুনে ওরা বলে, বাংলাদেশে কালচার এত সমৃদ্ধ আমাদের জানা ছিল না। কিছুদিন আগে আমি ও আরিফ রানা বাউলগানের একটা কনসার্টে গাইলাম। গান শোনার পর শ্রোতারা বললেন, ‘আমরা আজকে নতুন বাংলাদেশকে চিনলাম।’ এইভাবে সবাই যার যার মতো দেশের জন্য কাজ করলে আমাদের দেশের সুনাম ছড়াবে সব দেশে। আমরা তো আসলে বিদেশে নিজের দেশের দূতের মতোই কাজ করি।’

বাংলাদেশের অনেক শিল্পীও তো সেখানে কনসার্ট করতে যান?

সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তারা আসলে যান কমিউনিটির কনসার্টে। একবার এক কনসার্টে হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জাহাজে একটা কনসার্টে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা ছাড়া সেখানে কোনো বাঙালি ছিল না। ওই দিন জুয়েল ভাই আমাদের অনেক অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলেন। আমাদের অনেক ভালো লেগেছিল জুয়েল ভাইয়ের মতো একজন শিল্পীকে প্যারিসে পেয়ে। ওখানে আমরা আর এক-দুইজন বাঙালি মিউজিশিয়ান ছাড়া তেমন কোনো মিউজিশিয়ান থাকেন না। তাই আমরা চেষ্টা করি বাংলা গানগুলো তুলে ধরার। গান গাওয়ার আগে আমরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় গানটা সম্পর্কে বলে নিই। তারা তো আমাদের ভাষাটা বোঝে না। শুধু মিউজিকটা শোনে আর কণ্ঠ শোনে। এই সুরের মধ্যেই তারা বুঁদ হয়ে থাকে। ওরা চুপ করে আমাদের গানটা শোনে। ওরা আমাদের সুরটাকে অনুধাবন করার চেষ্টা করে। খুব এনজয় করে আমাদের গান।

আলজেরিয়ায় আপনার গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা বলুন...

পুরো প্যারিসে আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক হয় বারগুলোতে। অনেক বড় বড় ব্যান্ড সেখানে পারফরমেন্স করে। এটা মনের আনন্দেই করে সবাই। আমি আর আরিফ রানা ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কান, অ্যারাবিয়ান আরও অন্যান্য কমিউনিটির সঙ্গে নিয়মিত গান করি। এভাবেই আলজেরিয়ার শিল্পী যাইয়ানের সঙ্গে প্রচুর গান করেছি আমরা এক স্টেজে। একবার সে আমাদের আমন্ত্রণ জানাল আলজেরিয়ার একটা বড় শোতে। এভাবেই ওর অ্যালবামেও গান গাওয়া হয়। সেই গানে দোতারাও ব্যবহার করেছে আরিফ। আমি বাংলার সঙ্গে কাবিল ভাষা মিক্সড করে গান গেয়েছি। যাইয়ান আলজেরিয়ান হয়েও বাংলায় গেয়েছেন আমার সঙ্গে। আর আলজেরিয়ার সফরটাও ছিল একটা বড় সফর। আমার মনে হয় আমরাই প্রথম বাংলাদেশি যারা আলজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে গান গেয়েছি। আলজেরিয়ার এই সফরটি আমাদের জন্য একটি বিশাল পাওয়া। এখনো যাইয়ানের সঙ্গে কাজ করছি। মার্চ মাসেই আলজেরিয়ার একটা টিভি চ্যানেলে দুটো বাংলা গান করার কথা আছে। মরক্কোর মাবরুকস্টাইফি নামের আরও একজন শিল্পীর সঙ্গে গান গেয়েছি।

তারা তো বাংলা ভাষা বোঝে না। এরপরও বাংলা গান শোনে এটা কি আমাদের সুরের শক্তি? আপনি কী মনে করেন?

গানটা আসলে অনুভবের ব্যাপার। আমরা যেমন বাংলার পাশাপাশি ইংলিশ, স্প্যানিশ, তুর্কি গান শুনি। সব ভাষা তো আর আমরা বুঝি না। খুশি মনে শুনি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না। তারাও তাদের ভাষার পাশাপাশি বাংলা গান শোনে। তারা আমাদের ভাষা বোঝে না। কিন্তু আমাদের সুর অনুধাবন করছে। সুরের খেলা তো পৃথিবীর সব দেশেই সমান। একবার আমরা ইউনেস্কোর একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। পৃথিবীর ১৮টি দেশ সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। আমরা দ্বিতীয় হয়েছিলাম। আরিফ রানা যখন গাইছিলেন- ‘ধন্য ধন্য বলি তারে..’ তখন সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আর বাংলাতেই গাইছিল- ‘ধন্য ধন্য বলি তারে..’। আমরা গানের মধ্য দিয়ে এভাবে বিদেশে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার চেষ্টা করে আসছি। বাংলা গান ওদের ভালো লাগছে এটা আমাদের জন্য একটা বড় পাওয়া। এটা আমাদের মাটির ক্ষমতা, সুরের ক্ষমতা। অবশ্যই এটাকে কন্টিনিউ করতে চাই।

শুরুতেই একটা গান শুনেছিলাম আপনার। গানটার ভেতরে ছিল একাকিত্ব? এটা কি দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে?

মূলত দুটো কারণেই। দেশ থেকে অনেক দূরে থাকলেও মনটা আসলে দেশেই পড়ে থাকে। আমার অ্যালবামের সব গানের কথায় আমার মন থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য চিন্তা করে গানগুলো লেখা না। আর একাকিত্বের বিষয়টি দেশে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ফেলে ওখানে আসলেই আমরা একা।

প্যারিস হামলার সময়তো সেখানেই ছিলেন। সেই সময়ের কিছু স্মৃতি ...

খুব ভয়ংকর। প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ফ্রান্সে আছি। কখনোই এমন কোনো ঘটনা দেখিনি। সেই ঘটনা যখন ঘটে তখন বাসায় বসে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম। ঘটনাস্থল আমাদের বাসা থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বের। বাসার সামনে দিয়ে পুলিশের গাড়ি ছোটাছুটি করছে আমরা বাড়িতে বসেই শুনতে পাচ্ছি। সবাই খুব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন সব আগের মতোই স্বাভাবিক।

সবশেষে অ্যালবামটি নিয়ে পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলুন...

আসলে অনেক ভালোবেসে সঙ্গীত চর্চা করি। গানগুলো সবার ভালো লাগলেই নিজেকে সার্থক মনে করব। সবাইকে গানগুলো শোনার আমন্ত্রণ। সবাই বেশি বেশি বাংলা গান শুনবেন এই প্রত্যাশা।

দ্য রিপোর্টকে দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে যারা কাজ করেন আমার পক্ষ থেকেও সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

(দ্য রিপোর্ট/এএ/এএসটি/এম/মার্চ ০৮,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর