thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

বান্দরবানে পাহাড় কেটে বনাঞ্চল-জনবসতিতে ৪৭ ইটভাটা

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ০৬ ০০:১৭:৪৯
বান্দরবানে পাহাড় কেটে বনাঞ্চল-জনবসতিতে ৪৭ ইটভাটা

আলাউদ্দিন শাহরিয়ার, বান্দরবান : প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বান্দরবানে পাহাড় ও ফসলি জমি কেটে বনাঞ্চল-জনবসতির ভেতরে ৪৭টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইটভাটাগুলোতে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বনাঞ্চল, জনবসতি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে জেলার ছয় উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে এ সব ইটভাটা। ভাটাতে জ্বালানির জোগান দিতে বনাঞ্চল উজাড় করে সংগ্রহ করা হচ্ছে কাঠ। আর ইট তৈরি করতে পাহাড় ও ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে মাটির উর্বরতাশক্তি নষ্ট করা হচ্ছে।

প্রশাসনের তথ্যমতে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বনাঞ্চল, জনবসতি ও স্কুল-কলেজের একশ’ গজের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু বান্দরবানে মানা হচ্ছে না এই নিয়ম। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে বনাঞ্চল, জনবসতি এবং প্রাইমারি স্কুলের পাশেই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সবকটি ইটের ভাটা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারি অনুমোদন ছাড়া ইটের ভাটাগুলো বন্ধে সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কার্যত কিছুই হয়নি। স্থানীয়ভাবে প্রশাসনের তদন্ত রিপোর্টে ইটের ভাটাগুলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এ সব ভাটা স্থাপন বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা রহস্যজনক বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

সদর উপজেলার গুংরু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মংহ্লা প্রু খেয়াং এবং শিক্ষার্থী কেএসপ্রু খেয়াং ও উমেপ্রু খেয়াং জানান, তারা দূষণমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চায়, বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার নিরাপদ পরিবেশ চায়। ইটের ভাটার কালো ধোঁয়ায় শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীসহ কোমলমতি শিশুদের চোখ জ্বালাপোড়া করে। মাথাব্যথা করে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে। ইট ভাটার ধুলা বালিতে স্কুলে ক্লাস করা যায় না। বিদ্যালয়ের পাশের অবৈধ ইটের ভাটাগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তারা।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা জানায়, জেলা সদরের মাঝের পাড়া, গোয়ালিখোলা, ডলুপাড়া, ছড়ুই পাড়া, ছাইঙ্গা, টংকাবতী এলাকায় ১২টি, লামা উপজেলার ফাসিয়াখালী, ফাইতং, গজালিয়া, সরই, লামা ইউনিয়নের ২২টি, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, ঘুনধুম, সোনাইছড়ি, সদর ইউনিয়নে ৪টি, আলীকদম উপজেলায় ৩টি, রোয়াংছড়ি উপজেলার বাঘামারা, খানসামা এলাকায় ৩টিসহ জেলায় ৪৭টি ইটের ভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। আরও কয়েকটির ইট ভাটা নির্মাণের কাজ চলছে জোরেশোরে। জেলার প্রভাবশালীদের মদদে অবৈধভাবে ইটভাটাগুলো গড়ে তুলেছে।

ফাসিয়াখালী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও ফাইতং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম জানান, পাহাড় ও ফসলি জমি কেটে অবৈধভাবে ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। টিনের কাঁচা ড্রাম ও ব্রয়লার চিমনি বানিয়ে গড়ে তোলা ইটের ভাটাগুলোতে ইট পোড়াতে প্রকাশ্যে কাঠ জ্বালানো হচ্ছে। জ্বালানির যোগান দিতে পাশের বনাঞ্চল উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। ইট তৈরি করতে পাহাড় ও ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে মাটি মওজুদ করা হচ্ছে। ইটের ভাটাগুলোতে সরকারি কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। অভিযোগ দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের শষ্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আলতাফ হোসেন জানান, ইটের ভাটাগুলোর ফসলি মাঠ গ্রাস প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই বান্দরবানে বড় রকমের খাদ্য সংকট দেখা দিবে। পাহাড়ি জেলা হওয়ায় এখানে এমনিতেই ফসলি জমির পরিমাণ কম, তার ওপর ইটের ভাটার কারণে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় জেলার কৃষির ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। ইট ভাটাগুলো শুধু ফসলি জমি গ্রাস করছে তাই নয়, ভাটার মাটি যোগান দিতে কাটা হচ্ছে পাহাড়। আর জ্বালানি যোগান দিতে নির্বিচারে সরকারি-বেসরকারি বনাঞ্চল উজাড় করে কাটা হচ্ছে কচিকাঁচা গাছ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইটভাটা তৈরির আগে লাইসেন্স গ্রহণ, পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও নিয়ম কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যসা প্রু মারমা বলেন, আইন সকলের জন্য সমান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ইটের ভাটা গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও অনুমোদন বিহীন ইটভাটাগুলো বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসলাম বেবী জানান, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ইটের ভাটা স্থাপনের বিষয়টি জানা নেই। তবে অবৈধভাবে গড়ে তোলা মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তিনি ক্ষমতাসীন দলেরই হোক কিংবা বিরোধী দলের; আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নয়।

বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট কাজী মহোতুল হোসেন যত্ন জানান, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় জেলায় অবৈধ ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। ভাটা মলিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতার সংখ্যাই বেশি। পরিবেশ বান্ধব নয়, এমন ইটের ভাটাগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে ইটের ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

বান্দরবান মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম জানান, পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটের ভাটা। পাহাড় কেটে ও বনাঞ্চল উজাড় করে গাছ কেটে ইট ভাটাগুলোতে পোড়ানোর কারণে বান্দরবানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাহাড় ধসের ঘটনা বাড়ছে। ইটের ভাটার কারণে ঝিরি-ঝর্ণা পানির উৎস স্থলগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কেএম তারিকুল ইসলাম জানান, অবৈধ ইটের ভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট ইউএনও’দের পাহাড় কাটা এবং ইট ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইটের ভাটা মালিক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খায়রুল বাশার ও নাজমুল হক পিয়ারো এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদনে ইটের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পতিত জমিতে ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। আর্থিক সংকটে পরিবেশ বান্ধব ভাটা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

প্রশাসন ও বনবিভাগে অনুমতির আবেদন করেই ইটের ভাটাগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। জেলায় কোনো ইটের ভাটার আপডেট অনুমতিপত্র নেই বলেও জানান তারা।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/এইচএসএম/এনআই/এএল/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর