thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

রানা মুহম্মদ মাসুদ

 

জ্যোৎস্না-কুয়াশার জাল

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ১৪ ১২:৫০:৩৯
জ্যোৎস্না-কুয়াশার জাল

‘এইখানে এলে মনে হয় তুমি সবচেয়ে বেশী নেই

তোমাকে ক্ষণিক পাওয়ার জন্য এইখানে তবু আসি

মুগ্ধ পরান যতদূর চায় ততদূর ভালোবাসি।'

জলে পা দুখানি ডুবিয়ে বসে আছে সে। পাশের মাঠে, আম-নারকেলের গাছের মাথায় দুপুরের ভর রোদ দাঁড়িয়ে। পাড় ছুঁই ছুঁই পুকুরের পানি। চেনা বাতাসে জলজ গন্ধ। চোখ বুজে বুক ভরে সে গন্ধ টেনে নিলে গোপনে কি যেন পাওয়া হয়ে যায়। তার কানের নীল দুলখানি আনন্দে হাওয়ায় স্পষ্ট দুলছে। একটি মোড় ঘুরতেই চকিত দেখে নিয়ে সে নিমিষে পালিয়ে গেল। তখনও বকুলতলার পথে তার নগ্ন ভেজা পায়ের ছাপ। ঘাটের ওপর একখানি নূপুর, একটি চুলের কাঁটা। আমার বোধহয় একটু ভুল হয়ে গেছে। ভারি লজ্জা হল। তাই পাড় ছাড়িয়ে সোনালী গাছের নিচ দিয়ে বড় আইলটা ধরে দক্ষিণ দিকে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে পেছন বাড়ির আউলির মধ্যে নারী কণ্ঠের কলহাস্য কানে এল।

দুপুরের রোদের তেজ কমে যেতে থাকলে চারদিকে একটি অলস হাওয়া বয়। মানুষকে ঘরে বেঁধে রাখার সময়ের মোহ কেটে যেতে থাকে। খোলা মাঠ, মুক্ত আকাশ, পথ পানে ডেকে যায় গভীর গোপনে। সে ডাকে জরাগ্রস্ত মানুষ গৃহ আঁধারে ছটফটায়। ঘর আগলানো অদৃশ্য কারাগারে বন্দীর মতো নারীটি দাঁড়ায় আকাশের তলায়। নিঝুমতায় লেগে যায় মনুষ্য কোলাহল। আমিও অনুভব করি সে ডাক। তাই আকাশের আদিগন্ত শামিয়ানার আদিম গৃহটিই আমার বেশী প্রিয়।

‘স্বপন, এই স্বপন’ কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে কুসুম ডাকে। রাস্তা ছেড়ে কাঁঠালতলায় আসি। কুসুম আঙ্গুল নাড়িয়ে মুখ শক্ত করে বলল, দুপুরের সময় ঘাটের দিকে আস কেন!

টুপ করে আমার লজ্জাটা ভেসে ওঠে। যেমন তা খানিক সময়ে তলিয়ে গিয়েছিল। ‘ফের যদি দেখি...।’ কথা অসমাপ্ত রেখেই কুসুম হাঁটা ধরে। আমি অবাক। তার পরনে শাড়ি। হয়তো ভিন্নতায় মুগ্ধ করার হিসেবী ছল। নারী তোমার জীবনটাই ব্যাপক ছলের সমারোহ। ছল করে তুমি জীবন মধুর কর। ছল করে তুমি জীবন পোড়াও। কিন্তু অনিপুণ জড়ানো খয়েরি শাড়িটা গতি থামিয়ে দেয় উদাসী বৈরিতায়। টলে উঠে কুসুমের একহারা শরীরটা। যন্ত্রের মতো দুই হাতে আগলে নেই। মুহূর্তে এক ঝলক ঘ্রাণ আমার অনুভব মাতিয়ে যায়। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তার নিজস্ব ঘ্রাণটাকে আরাধ্য করে নেই। স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। কুসুম শীতল কণ্ঠে বলল, ছাড়ো। তারপর শিথিল বাহু ছাড়িয়ে শাড়িটা একটু গুছিয়ে নিয়ে পা বাড়াল। কেবল একবার পেছনে ফিরে এতক্ষণের সবকিছুর মাশুল দেওয়ার মতো লজ্জা মিশিয়ে একটু হাসল।

কিছু মানুষ আছে যারা আপন করে ভালোবেসেই শুধু প্রিয় হয় না, আপন করে না। তাদের বিরুদ্ধতা, শাসন, দূরে ঠেলাও যেন কাছে টানার উপলক্ষ। কুসুম যদি একটু নাও হাসত, অনুরাগের ক্ষুদ্রতম চিহ্নও না ফেলত তবু আমি বুঝতাম সে আমায় বকে, মেরে, শাসন করে ভালোবাসতেই চায়।

দুই

‘এখনো বাসিনি ভালো পুরোপুরি

নিয়ন্ত্রণে রেখেছি কিছু প্রেম

অপূর্ণ রেখেছি কিছু অন্তরঙ্গ

প্রেমের বাসনা।’

কুসুম একটি কুল বাড়িয়ে দিল। অন্য হাতে আধখাওয়া আরেকটা।

- এটা থাক। আধখাওয়াটাই দাও।

- ওটা কেন? ও যে আমার এঁটো করা।

- তাতেই ও অমৃত হয়ে গেছে।

লজ্জার বিভায় কুসুম মুহূর্তে আরও পুষ্পিত হয়ে ওঠে। মেয়েরা ব্যথায় সুন্দর হয়, আনন্দে সুন্দর হয়, সুন্দর হয় লজ্জায়। তারপর হয়তো তার মানানসই বাধাটা ফুটে উঠবে। তাই আমার ক্ষিপ্র হাতখানার মধ্যে তার এঁটো কুলের হাতখানা বন্দী হয়ে পড়ল। কিন্তু হাতের মধ্যে হাত কথা কয়ে ওঠে না; বরং তার অন্য হাত আমার বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে মাংস খামছে ধরে। তখন তার আঙ্গুলের নড়াচড়া কি এক সুরে যেন বাঁধা হয়ে গেছে। তবু কুলটা নিতে পারেনি। চকিত মুখে পুরে দিলাম। অমনি প্রচণ্ড তেজে তার নখগুলো মাংসে ডুবে গেল। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। খানিক পর চোখ মেলে দেখলাম কুসুম আর নেই। তার আঙ্গুলগুলো চেতনায় ভাসছে। বাঁ হাতের তিনটি স্থান থেকে রক্ত সর্পিল গতিতে এগিয়ে গিয়ে আঙ্গুল বেয়ে টপটপ মাটিতে পড়ছে। কুসুম আবারে এল। অসীম বিহ্বলতা তার চোখে। আমার রক্তাক্ত হাতখানি জড়িয়ে ধরে তীব্র আবেগে কেঁদে উঠল। কত নিষ্ঠুর আমি, কথাটি বলে ক্ষরণের স্থানগুলো চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল। কুসুমের ঠোঁট, গাল ছোপ ছোপ রক্তের দাগে চিত্রিত হয়ে যায়। আমি চোখের জলে ভেজা তার মুখখানি একটু তুলে ধরলাম।

এখন বলার মতো কি কথা আছে। সারাটা জীবন আমার বুকের কয়টা অনুভব ভাষায় বুঝিয়ে দেই। বেশীর ভাগই বুকে নিয়ে নীরবে মরে যাই। মনে মনে ভাবি, কুসুম তুমি আমায় ভালোবাসতে এসেছ, আমিও তোমায় ভালোবাসা দিয়েছি। তুমি পূর্ণ হয়ে গেছ। এ অনন্য লেনদেনে নারী অপার্থিব সুন্দর হয়ে যায়, শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়।

আমার নীরব মুখের দিকে তাকিয়ে কুসুম বলে, ‘স্বপন, যেদিন বুঝেছি আমি নারী, নারীত্বের সেই প্রথম উপলব্ধিতেই তোমায় ভালোবেসেছি। এ আমার জীবনব্যাপী আলোময় সত্য।’
আশ্চর্য! পৃথিবীজুড়ে প্রয়োজনীয় কথা বলার অপ্রয়োজনীয়তারও কমতি নেই। মনের সঙ্গে মনের অনিবার্য বোঝাপড়ায় কথারা যে বড়ই বাহুল্য। কুসুম তোমার সুরভিত ভাবখানি আর অগোচর কি। তোমার চোখের পলকের ভঙ্গিতে, হাতখানা নাড়ানোর মুদ্রায়, নুঁয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়ার ডালখানা ছুঁয়ে দেওয়ার চাঞ্চল্যে, চুল ওড়ার উদাসীনতায়, কপালে কোমল ঘামে তোমার বাসনার অতল নিংড়ে কবেই তোমার মরণে মন সপেছি। কুসুম তুমি টেনে নেওয়া নিঃশ্বাসের বাতাসে জীবনানন্দ ছড়িয়েছ।

ওই মুহূর্তে আমার মনে হতে থাকে, নারী তুমি পৃথিবীর প্রাণকাব্য। বিধাতার সৃষ্টির পূর্ণতা। তোমার লাবণ্যময় হাতখানা মেলে ধর। তার মাধুর্যে অনিত্য পৃথিবীর অনিবার্য মৃত্যু দুয়ার বেখেয়ালেই উৎরে যাব। হায়! প্রেমিক জীবন। প্রেমময় কটি অতৃপ্ত মুহূর্ত। সৃষ্টিকর্তার নারী কাব্যের ভেদহীন রহস্য বিশ্বাসীদের প্রার্থনার কপাল পবিত্র পদতলে লুটাতে কিনে নেয় কৃতজ্ঞতার মূল্যে।

কুসুম তার ওড়নার একটা প্রান্ত আমার হাতে বেঁধে দেয়। এভাবে যদি আপনই করবে তবে আরও রক্ত ঝরাও। ভালোবাসা ছুঁয়ে জীবন বড় গৌরবময়, বড় ছোট। আনমনে উঠতে গিয়ে কুসুমের ওড়নায় টান পড়ে। ‘আর তো যাওয়া চলে না। গাঁটছড়া যে বাঁধা হয়ে গেছে।’ লজ্জা! লজ্জা! কুসুম মুখ লুকিয়ে নেয়। বাঁধনটা আগলা করে দেই। রক্তাক্ত প্রান্তটা মুঠো করে কুসুম বুকে চেপে রাখে। বলি, কুসুম কান পাতো। কানে কানে আজ একটা কথা বলব, ‘কোনোদিন আর বলব না। তবে জীবনভর তা তুমি জানবে, অনুভব করবে।’ কুসুম কান এগিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। আমি হাওয়ায় ভেসে প্রথম বললাম, কুসুম ভালোবাসি, ভালোবাসি।

তিন

‘হয়তো তোমারে সে পরশ করি আসে,

হে প্রিয়া মনে মনে ভাবিয়া তাই

সকল অঙ্গেতে সে বায়ু মাখি লয়ে

পরশ তব যেন তাহাতে পাই’

সন্ধ্যা উতরে গেছে। সামনে একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে নদী। পেছনে সবুজের কালো দেয়াল ছুঁয়ে উঠেছে দশমীর চাঁদ। নদীর বাতাসে মাঝারি শীতের টান। সময়ে-অসময়ে তীব্র ভালোলাগায় এখানেই আসি আমি। দূরে হৈ-হুল্লোড় শোনা যায়। কোনো জন-মানুষ নেই। তবু ভয় লাগে না। কুসুম এতক্ষণে হয়তো পুকুরের ঠাণ্ডা জলে পা দুখানি ধুয়ে পড়তে বসেছে। উত্তরে বাতাসের জ্বালাতনে বন্ধ জানালা। আর ওপাশে ফুলেল শতমুখে হেসে উঠেছে গন্ধরাজ গাছটা। তার তীব্র সুবাস জানালার ওপাশে কুসুমকে খুঁজবে। আর পড়তে পড়তে হঠাৎই কুসুমের মন খারাপ হবে। আমার কথা তাকে ব্যথা দেবে। আমাকে কেউ ভাবে, আমার জন্য কেউ কষ্ট পায়- যে যাই বলুক পৃথিবীতে এটি বড় সুখের। জীবনে মূলত নারীরাই বেঁধে দেয় এ সুখের সুতোটি। তারা মা হয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ত্যাগী, বোন হয়ে স্নেহের নির্ঝরণী আর প্রণয়ী হয়ে করে ত্যাগ ও ভালোবাসায় স্বপ্নসৌধ নির্মাণ। আর এ সব যেন অনিত্যের ভিতে স্থায়িত্বের বিনির্মাণ।

আমি একেবারে নদীর জলের কাছে চলে আসি। তখন হঠাৎই মন খুব করে দুলে ওঠে, অনিশ্চিত নিয়তির অসহায় জীবন। কুসুম কি জানে যে, এক নিমিষে মুছে যেতে পারে সব। তীরের ভেজা মাটিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের কলধ্বনিতে আমার ভাবনায় ভেসে উঠতে থাকে কুসুমের চোখ, নাক, চুল, হাত, খোলা পা, কপাল, ঠোঁট। আমার বুক ভরে কান্না আসে। অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি, হে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। এমন মহিমান্বিত খেলা তোমাকেই মানায়। জীবনের সীমাবদ্ধতায়ই হয়তো প্রেমকে অমন ঐশ্বর্যময় করেছ। কিন্তু তার প্রকৃতি বোঝার মনের তাৎক্ষণিক স্বচ্ছতাটুকু কই! সংশয়িত ভাঙনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে তা যে হাতড়ে খুঁজে ফিরি। তখন চাঁদটুকু মাঝ আকাশে। বেড়েছে আলোর তীব্রতা। চকমকিয়ে উঠছে নদীর জল। দিগন্তের দিকে বহু তারা । চোখ মুছে চারপাশে তাকাই। কেউ নেই চারপাশে। কেবল জ্যোৎস্না-কুয়াশার জাল।

[গল্পের প্রথম দুই অনুচ্ছেদের পঙক্তি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে এবং শেষেরটি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাস থেকে নেওয়া।]

লেখক : প্রতিবেদক, দ্য রিপোর্ট

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর