thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

২৫টির বেশি হামলা হয়েছে নব্য জেএমবি প্রধানের নেতৃত্বে

২০১৬ অক্টোবর ২১ ২৩:২৬:৪৭
২৫টির বেশি হামলা হয়েছে নব্য জেএমবি প্রধানের নেতৃত্বে

মো. শামীম রিজভী, দ্য রিপোর্ট : আশুলিয়ায় র‌্যাবের হাত থেকে পালাতে গিয়ে নিহত নব্য জেএমবির প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ ওরফে আবদুর রহমান ওরফে সারওয়ার জাহানের নেতৃত্বে ২৫টিরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সব ঘটনায় বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের দেশি-বিদেশি বহু মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন সহস্রাধিক।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, ২০০৭ সালে বাংলা ভাই ও শাইখ আব্দুর রহমান গ্রেফতার হওয়ায় জেএমবি বিশৃংখল হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৪ সালে নতুন ধারার ধর্মীয় উগ্রবাদ মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরাতন জেএমবি নতুন চেতনায় নব্য জেএমবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। নব্য জেএমবি পরবর্তী সময়ে স্বশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে এবং একই সাথে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এর পর নব্য জেএমবি’র সাধারণ সদস্যরা সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমানকে সূরা সদস্যে মনোনিত করে। অন্যান্য মনোনিত সূরা সদস্যরা সারোয়ার জাহানকে নব্য জেএমবির আমির হিসাবে ঘোষনা করে এবং সারোয়ার জাহানের সাংগঠনিক নাম দেওয়া হয় শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের পরামর্শে নব্য জেএমবির সদস্যরা ইনগিমাস (গুপ্ত হামলা) হামলা পরিচালনা শুরু করে।

গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানান যায়, ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট চট্টগ্রামে মিরেরসরায়ে আওয়ামী লীগ নেতা ইমরানকে গুলি করে ৬০ লাখ টাকা ছিনতাই করে নেয় এবং একই বছর ৪ সেপ্টেম্বর তারা চট্টগ্রামের বাংলাবাজারে নেংটা বাবা ও তার এক সহযোগীকে হত্যা করে। মূলত এ দুটি অপারেশন সফলভাবে পরিচালিত হওয়ায় শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফকে নব্য জেএমবির সূরা সদস্যরা বাংলাদেশের নব্য জেএমবিতে বায়াত দেওয়ার জন্য অনুমতি দেয়। উদ্ধার নথিপত্র অনুযায়ী শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নেতৃত্বে নব্য জেএমবি বাংলাদেশে দাওয়াত, ইলেম ও তাসকীয়া, ইয়ানত, ইদাদ গ্রুপ, রিবাহ্ এবং কিসাক বা ফিত্না নিরোধন ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করত বলে জানা যায়।

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট ও ৪ সেপ্টেম্বর জেএমবির দুটি অপারেশন সফল হওয়ার পরে তারা একের পর এক হত্যা অপারেশন চালাতে থাকে। তারা বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার পরিকল্পনা করে। বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারায় বসবাসরত বিদেশী নাগরিকদের উপর আক্রমন করা। এছাড়া, রাফিদাদের মন্দির, হুসনি দালান, মোহাম্মদপুরে রাফিদাদের মন্দির (শিয়া মসজিদ), ঢাকা মিরপুরে ইমাম বারাতে আক্রমন করার পরিকল্পনাও করে তারা। তাদের ভাষায় তাগুতের সৈনিক অর্থ্যাৎ র্যারব, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী এবং ব্লগার নাস্তিকদেরকে যেখানে পাবে সেখানেই আক্রমন করে হত্যা করা।

র‌্যাব জানায়, নব্য জেএমবির নথিপত্র থেকে জানা যায়, শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ ওরফে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান-২ এ ৯০ নম্বর রোডের মাথায় ইটালীয় নাগরিক সিজার তবেলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কাচু আলুটারী গ্রামে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে (৬৫) গুলি করে হত্যা করে। ৫ অক্টোবর সকালে পাবনার ইশ্বরদী পৌর এলাকার নিজ ভাড়া বাসায় ছুরিকাঘাতে ব্যাপিষ্ট মিশন ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গডের ফাদার লুক সরকারকে (৫০) হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২২ অক্টোবর রাত নয়টার দিকে গাবতলী পর্বত সিনেমা হলের সামনে পুলিশ চেক পোষ্টে যানবাহন তল্লাশীকালে দারুস সালাম থানায় কর্মরত এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে (৪০) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

২৩ অক্টোবর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে পুরান ঢাকার হোসনি দালানে বোমা হামলায় এক কিশোর নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হন। ৪ নভেম্বর সকাল পৌনে আটটায় নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কের নন্দন পার্কের সামনে পুলিশ চেকপোষ্টে ডিউটিরত শিল্পপুলিশ সদস্য মুকুল হোসেনকে (২৩) ধারালো অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করে। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর বিআরটিসির বাসডিপোর সামনে খ্রিষ্টান ইতালীয় ধর্মযাজক ড. পিয়েরো পারোলারি সামিওকে (৬৪) গুলি করে হত্যার চেষ্টা, ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে শিয়া মসজিদে মাগরিবের নামাজের সময় ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করায় মসজিদের মুয়াজ্জিম মোয়াজ্জিম হোসেন (৬০) নিহত হন এবং গুলিবিদ্ধ হন ইমামসহ তিনজন মুসল্লি। ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির সুরক্ষিত এলাকার দুটি মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে মোট ছয়জন আহত হন।

চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় শ্রী শ্রী সন্ত গৌরীয় মঠের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর দাসাধিকারীকে (৫০) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিককে (৬৮) মহিমাগঞ্জ বাজারে দোকানের ভেতর কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা, ২৫ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিককে (৬৮) মহিমাগঞ্জ বাজারে দোকানের ভেতর কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা, ৫ জুন ২০১৬ তারিখ নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়া খ্রিষ্টান পল্লীতে দিন দুপুরে সুনীল গোমেজ (৬০) নামের এক মুদি ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা, ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের মহিষডাঙ্গা গ্রামের আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৭০) নামে এক বৃদ্ধ পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

১০ জুন খ্রিস্টান ধর্ম জাজক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে (৬০) পাবনার হেমায়েতপুরে মানসিক হাসপাতালের সামনে কুপিয়ে হত্যা, ১৫ জুন মাদারীপুর শহরে সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে হত্যার চেষ্টা, ১ জুলাই ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাস্টাসাগরা গ্রামে রাধামদন মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা, একই দিন ১ জুলাই শুক্রবার রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কে আর্টিজান বেকারী অ্যান্ড রেষ্টুরেন্টে হামলা করে। এ সময় দেশি-বিদেশি ও পুলিশসহ মোট ২২ জনকে নৃশংসভাবে গ্রেনেড ছুড়ে, জবাই ও গুলি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। ৭ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কিশোরগঞ্জ জেলার শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে পুলিশ চেকপোষ্টের উপর হামলা করা হয়।

এ ছাড়াও কাদিয়ানী মসজিদে বোমা হামলা, পঞ্চগড়ে হিন্দু পুরহিতকে হত্যা, কুড়িগ্রামে খ্রিস্টান পাদ্রী হত্যা, ঝিনাইদাহে রাফিয়া শিয়া ধর্ম প্রচারককে হত্যা।

এ বিষয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ শুক্রবার বলেন, ‘এলিট ফোর্স র‌্যাব তার সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীণ অবস্থানে থেকে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। র‌্যাবের কর্ম তৎপরতার কারনেই সারাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন সময়ে নাশকতা সৃষ্টিকারী জঙ্গি সংগঠন সমূহের শীর্ষ সারির নেতা থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদেরকেও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। গত ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলার পর র‌্যাবের অভিযানে ৬ জঙ্গি নিহত এবং ৩৩ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে পূর্বের মতো সারাদেশে একযোগে নাশকতা সৃষ্টি করাসহ পরিকল্পিতভাবে কোথাও বোমা বিস্ফোরণের সক্ষমতা না থাকলেও, যে সকল জঙ্গি জেলখানার বাইরে আছে তাদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে র‌্যাবের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারী ও অভিযানের ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতা কর্মীরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েও বার বার ব্যর্থ হয়েছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি গত ৮ অক্টোবর গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার বাইপাইল আশুলিয়ায় পৃথক পৃথক তিনটি জঙ্গি আস্তানায় র্যারবের সফল অভিযান পরিচালনায় চার জঙ্গি নিহত হয় এবং অপর এক জঙ্গি আব্দুর রহমান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। নিহত আব্দুর রহমানই নব্য জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। তার বাসা থেকে জেএমবির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পাওয়া যায়।’

এ সময় জঙ্গিদের বিভিন্ন সাংগঠনিক চিঠি ও নথিপত্র তুলে ধরেন তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/এম/এস/অক্টোবর ২১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর