thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

ইরাক ফেরত ১১ বাংলাদেশি

গোয়ালে কেটেছে ৮ মাস!

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬ ২১:৫০:৫১
গোয়ালে কেটেছে ৮ মাস!

ইরাক ফেরত বাংলাদেশি শ্রমিক মো. মাসুদ রানা। অবৈধ ভিসায় দীর্ঘ ৮ মাস ইরাকে নির্যাতনের শিকার হয়ে যে ১১ জন শ্রমিক দেশে ফিরেছেন তাদের মধ্যে একজন তিনি। বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মুরাদহ শেখ পাড়ায়। বাবার নাম নুরুল ইসলাম। চেহারা-ই বলে দেয় এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হননি। ১৮ বছর না হলে বিদেশে যাওয়া তো দূরের কথা, দেশেও কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার আইন নেই। অথচ তিনি দালালের খপ্পরে পড়ে ইরাকে যান জাল ভিসায়, জাল জন্ম সনদে।

রাজধানীর ইস্কাটন রোডের প্রবাসী কল্যাণ ভবনের নিচে রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কথা হয় মাসুদের সঙ্গে। ইরাকে আটক ১৬ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে তার মতো আরও ১০জন ইরাক ফেরত শ্রমিককে দেখা যায় সেখানে।

মাসুদ জানায়, ঘাটাইলের মুমিনপুর ডিএসপি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে জেএসসি পাস করেছেন তিনি। এ সময় আমীর হোসেন নামে গ্রামের এক দালালের খপ্পরে পড়েন। প্রলোভন দেখায় বিদেশে যাওয়ার। অভাবের সংসার মাসুদের। তাই তার বাবাও এক সময় দালাল আমীরের কথায় রাজি হয়ে যান। মাসুদকে বিদেশে পাঠানোর সকল বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব পায় ওই আমীর হোসেন।

আমীর হোসেন ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (আর এল-১১৫৫) স্বত্বাধিকারী নাসির খানের মানবপাচার চক্রের সদস্য। বিষয়টি জানা ছিল না মাসুদদের। তিনি বলেন, ২০১২ সালের জুলাই মাস থেকেই আমীর হোসেন বিভিন্নভাবে তাদের প্রলোভন দেখাতে থাকে। ওই বছরই আমি পাসপোর্ট করি। ৪ লাখ টাকায় ইরাকে পাঠানোর চুক্তি হয় তার সঙ্গে। মাসিক বেতন দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকা। যদিও পরে লিখিতভাবে বলা হয় বেতন হবে ৩৫০ ইউএস ডলার। তিন মাসের এন্ট্রি ভিসায় ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ ইরাকে পাঠায়। ওই দিন আমিসহ ৬ জন ইরাকের নাজাফ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে পৌঁছামাত্র পুলিশ আমাদের ভিসাসহ স্মার্টকার্ড দেখতে চায়। আমরা তাদের দেখালে ভিসা ও স্মার্টকার্ড জাল বলে জানায়। এবং আমাদের সেখানেই ৪দিন আটক রাখে।

মাসুদ আরও বলেন, ৪ দিন পর এম কোদিয়া জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির মালিক আলী হায়দার এক মাসের ভিসা তৈরি করে আমাদের বিমানবন্দর থেকে নাজাফ আশরাফ মানতাকা মজুম্মা, আবু তরুফ নামক স্থানে তার কোম্পানি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মরুভূমির মধ্যে টিনের ছাউনি দেওয়া ক্যাম্পটি একটি গরুর গোয়ালের পাশেই। বাধ্য হয়ে অনেক সময় ওই গোয়ালের ভেতরেও থাকতে হয়েছে। বৃষ্টি হলে পানি পড়ত। ওখানে পৌঁছলাম রাতে। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের মতো আরও ২১ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। আমরা যে ৬ জন নতুন গেলাম তাদের আর রাতে খাওয়া হল না।

দীর্ঘ ৮ মাস কীভাবে ওই ক্যাম্পে কেটেছে তা বর্ণনা করেন মাসুদ। নিদারুণ কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। কোম্পানি মালিক কীভাবে তাদের ওপর নির্যাতন করেছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখে পানি আসে বার বার। তাই কয়েক মিনিট পরপরই চোখ মুছেন তিনি।

মাসুদ বলেন, সকালে খেতে দিল। পেটে প্রচুর ক্ষুধা। ৪ দিন এয়ারপোর্টে বন্দি ছিলাম। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া হয়নি। মনে করেছিলাম পেটপুরে খাব। কিন্তু পেলাম একটা রুটি। সঙ্গে মসুরের ডাল। ডালের মধ্যে পোকা ভাসছে। খাওয়া হল না আর। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? পেট তো আর মানে না। ভাত রান্না করে পচা চাল দিয়ে। ডাল দেয় তাতে পোকা। শেষ পর্যন্ত এ সবই আমাদের খেতে হয়েছে। দু’য়েক দিন পরপরই পেটের পীড়াসহ নানা অসুখে ভুগতে হয়েছে। আড়াই মাস পর ২০১৩-এর মে মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ থেকে মেসার্স মর্নিং সান এন্টারপ্রাইজের (আরএল-৮৪৫) মালিকের পিএস অলিউল করিম ইরাকে আমাদের কাছে যায়। আমরা তার কাছে দুঃখ দুর্দশার কথা জানাই। বেতন-ভাতার কথা বলি। তিনি আমাদের জানান, ‘তোমরা চিন্তা করো না। কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানি চালু হবে। সব তোমরা ঠিকঠাক পাবে।’ একদিন তার কাছে আমরা আবার বেতন-ভাতার দাবি জানালাম। তিনি তখন বললেন, ‘তোমরা তো বিদেশের নিয়ম জান না। ৩ মাস পর এক মাসের বেতন দেওয়া হবে। দুই মাসের বেতন কোম্পানির কাছে আটকা থাকবে।’

মাসুদ আরও বলেন, উনি(অলিউল করিম) কোম্পানির মালিকের বাসায় থাকলেন। ৩ মাস পূর্ণ হল। এরপর আবারও দাবি জানালাম বেতনের। তিনি তখন আমাদের সবার একাউন্ট নম্বর চাইলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশে গিয়ে তোমাদের সবার বেতন দিয়ে দেব।’ আমরা নম্বর দিলাম, কিন্তু টাকা আর পেলাম না।

হতভাগ্য এ কিশোর জানান, কোম্পানি মালিক আলী হায়দার ও তার ভাই নিয়মিতভাবে আমাদের ওপর নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন চালাত। অনেক সময় অলিউল করিমের উপস্থিতিতে মারধর করা হত। সামনে যা কিছু পেত তাই দিয়ে পেটাত, ছুঁড়ে মারত। কারো কারো গলা চেপে ধরত। মেরে ফেলার হুমকি দিত। আমরা যখন কাজ চাইতাম, বেতনের দাবি করতাম তখন অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যেত। ক্যাম্পেই আমাদের আটকে রাখা হতো। কাজ নেই। এরপরও বের হতে দিত না। যখন আমরা কাজ চাইতাম, বেতন চাইতাম, তখন মালিক আমাদের দিয়ে এক জায়গার বালু আরেক জায়গায় বহন করাত। আবার সেই বালু আগের জায়গাতেই নেওয়ার কাজ করাত।

মাসুদ বলেন, অলিউল এম কোদিয়া জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির মানবপাচারের অন্যতম সদস্য। কয়েক মাস পর তিনি আবারও ইরাকে গেলেন। এরই মধ্যে আমরা সবাই আমাদের পরিবারের কাছে নিজেদের ওপর মালিকের জুলুম নির্যাতনের কথা বললাম। ফলে ঢাকায় আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা মানববন্ধন করল, মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে থাকল। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কাজের ব্যবস্থা না হলে উদ্ধার করে দেশে পাঠানোর জন্য ইরাকে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দিলেন। এ ব্যাপারে আমরা ইরাকের বাংলাদেশি অ্যাম্বাসিতেও ফোন করতে থাকি। কিন্তু ফোন ধরে না। ধরলেও আমাদের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নানাভাবে সেখানকার কর্মকরর্তারা আমাদের হুমকিও দেন। অ্যাম্বাসির স্টাফ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে অলিউরের বন্ধুত্ব। কুমিল্লার বরুড়া এলাকাতেই নাকি তাদের বাড়ি। তিনি আমাদের জীবন নাশেরও হুমকি দিয়েছেন বারবার। বলেছেন, ‘তোমাদের ওখানেই থাকতে হবে।’

এভাবেই ৮ মাস চলে গেল। একদিন ইরাকে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গেলেন। তিনি শুধু মালিকের সঙ্গেই কথা বললেন। আমাদের সঙ্গে ৫ মিনিটও কথা বললেন না। আমরা তার কাছে আমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলার চেষ্টা করি। আমরা কাজের দাবি করলে তিনি বলেন, ‘আমি কি তোমাদের জন্য কোম্পানি খুলে বসেছি?’ কাজ দিতে না পারলে ৮ মাসের বেতন-ভাতা দিয়ে দেশে ফেরত যাওয়ার দাবি জানালে তিনি বলেন, ‘এটা পারব না। তোমাদের স্মার্ট কার্ডগুলো ভুয়া। ঢাকায় তো এ সব খাচি করে বিক্রি করে।’

মাসুদ বলেন, আমরা তো সাধারণ মানুষ। স্মার্ট কার্ড যদি নকল হয়, ভিসা যদি জাল হয় তাহলে ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে কেন ঠেকানো হল না। শাহজালালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ডেস্ক, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আমাদের চেক করল, ফিঙ্গার প্রিন্ট নিল। কেন আমাদের বাধা দেওয়া হল না।

জানা যায়, ২৭ জনের মধ্যে ১১ জন গত ৩০ নভেম্বর দেশে এসেছে। বাকিরা এখনও ইরাকেই আছে। তাদের মধ্যে দুইজন সেখান থেকে পালিয়েছে। অন্যরা নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। মাসুদ বলেন, মন্ত্রী সাহেব আমাদের বলেছিলেন ৪ দিনের মধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন। এক মাস চলে গেল কিন্তু তাদের তো আনা হচ্ছে না। তাই আমরা এখানে এসেছি অবস্থান করতে।

ইরাক ফেরত নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভাগ্যাহত বকুল হোসেন জানান, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ৮০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। এখন একদিন দু’দিন পরপরই ব্যাংক থেকে তাকে ফোন দেয়। হুমকি দেয় টাকা দিতে না পারলে পুলিশে ধরিয়ে দেবে। তিনি বলেন, এখন কি করব বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে এত টাকা দেব।

একটি ছবি সামনে ধরে তিনি বলেন, ‘এই দেখেন প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি সাহেব নিজ হাতে আমাকে ব্যাংক ঋণ দিয়েছেন। ভিসা যদি জাল হয়, স্মার্ট কার্ড যদি ভুয়া হয় তাহলে কেন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হল না, কেন তাহলে ব্যাংক আমাকে ঋণ দিল।

প্রবাসী কল্যাণ ভবনের নিচে কথা হয় আরও কয়েকজন ইরাক ফেরত হতভাগ্যের সঙ্গে। তারা একই সুরে বলেন, যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। আটকদের দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, ক্ষতিপূরণসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে মেসার্স মর্নিং সান এন্টারপ্রাইজ (আরএল-৮৪৫), মেসার্স মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-১১৫৫), মেসার্স ইস্ট বেঙ্গল ওভারসিজ (আরএল-৯১২) ও মেসার্স আইডিয়া ইন্টারন্যাশনাল লি.(আর এল-৯৫৩) নামে ৪টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ২৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক ইরাকে যায়। মাসে তাদের ৩৫০ ইউএস ডলার বেতন দেওয়া হবে এই শর্তে কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৩-৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। ইরাকের একটি কোম্পানিতে দীর্ঘ ৮ মাস মানবেতর জীবনযাপন করার পর ১১ জন দেশে আসতে সক্ষম হলেও বাকিরা সেখানেই রয়ে যান।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মহসিন উদ্দিন চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, কাল(সোমবার) ১৩ জন দেশে ফিরছেন। বিষয়টি আন্দোলনরতদের পক্ষ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর