thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

নতুন আমেরিকা, পুরোনো আমেরিকা

২০১৬ নভেম্বর ০৭ ২৩:২৮:০৫
নতুন আমেরিকা, পুরোনো আমেরিকা

আহমেদ সুমন

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর)। বিশ্ব রাজনীতিতে উৎসুক ব্যক্তি মাত্রেরই দৃষ্টি আমেরিকার দিকে, কে হচ্ছেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট- হিলারি ক্লিনটন না ডোনাল্ড ট্রাম্প? দিনটি আমেরিকার জন্য তো বটেই পুরো পৃথিবীর ঘটনাবলির জন্যই এক ঐতিহাসিক দিন। আমেরিকার ৪৮তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে কে প্রবেশ করবেন- তা আর মাত্র ১২ ঘণ্টা পরই জানা যাবে। প্রেসিডেন্টের রানিংমেট হিসেবে এদিন একজন ভাইস-প্রেসিডেন্টও নির্বাচন করা হবে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল অবশ্য ঘোষণা করা হবে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি।

আমেরিকায় নির্বাচনী ধরনে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিদ্যমান থাকলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন ইলেক্ট্রোরাল কলেজের সদস্যগণ।ইলেক্ট্রোরাল কলেজের সদস্যগণ আমেরিকার অধিবাসী কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। অতঃপরইলেক্ট্রোরাল কলেজের সদস্যগণ কর্তৃক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে ২৭০ইলেক্ট্রোরাল ভোটের প্রয়োজন হয়। নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন জরিপ সংস্থাগুলো একের পর এক পূর্বাভাসে দুপক্ষেরই স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো জরিপে হিলারি, আবার কোনোটিতে ট্রাম্প এগিয়ে রয়েছেন। গণমাধ্যমগুলো তরুণ সমাজ ও শ্বেতাঙ্গদের একটি অংশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে চাচ্ছে বলে খবর প্রকাশ করেছে। অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক, ল্যাটিনো, সরকারি চাকরিজীবী, নারীসমাজ, মধ্যবিত্ত, ধনিক শ্রেণি আবার হিলারির পক্ষে বলে খবর ছেপেছে। গণমাধ্যমগুলো আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেরইলেক্ট্রোরাল ভোটের একটি হিসাব-নিকাশও তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, অ্যারিজোনা, কলোরাডো, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, আইওয়া, মিশিগান, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়র, নর্থ কারোলাইনা, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া, উটাহথ ১২ রাজ্যের মোটইলেক্ট্রোরাল ভোট ১৫৬। ২০০৪ সালে কলোরাডোতে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিলেন রিপাবলিকানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র)। তার পর থেকে রিপাবলিকানের ভেতরে ভেতরে একটা বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল, কলোরাডো রিপাবলিকানের ঘাঁটি। ওই রাজ্যে আগামীবারও তাদেরই জয় নিশ্চিত। ঘটল উল্টোটা। ২০০৮ সালে দেখা গেল, কলোরাডোতে রিপাবলিকানের ভরাডুবি, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামার পক্ষে সব ভোট। এবারের জরিপ, কলোরাডোতে হিলারির জয় হবে। কিন্তু হিলারি শিবিরে সে নিশ্চয়তা নেই। সিএনএনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট দৌড়ে হিলারিই এগিয়ে আছেন। ১০০ জনে ৪৭ জনই হিলারিকে চান। ট্রাম্পকে মাত্র ৪২ জন। সিএনএনেরইলেক্ট্রোরাল জরিপেও হিলারি এগিয়ে। ৫৩৮ইলেক্ট্রোরাল ভোটে ২৬৮টি পাবেন হিলারি। ট্রাম্পের পক্ষে ২০৪ ভোট। ফক্স জরিপের হিসাবে আবার হিলারি-ট্রাম্পের মধ্যে ব্যবধান দুই পয়েন্ট। ৪৫ শতাংশ ভোটারের রায় হিলারির পক্ষে, ট্রাম্পের পক্ষে ৪৩ শতাংশ। জরিপ সংস্থা ন্যাট সিলভারের হিসাবে, হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের সম্ভাবনা ৬৫ শতাংশ। ট্রাম্পের ৩৫ শতাংশ মাত্র। সিলভার মডেলের জনমত, কম করে হলেও ২৯০টিইলেক্ট্রোরাল ভোট পাবেন হিলারি। ট্রাম্প টেনেটুনে ২৪৮। মুডি’স এনালিটিক্সের ঘোষণা, হিলারিই প্রেসিডেন্ট হবেন।

আমরা হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানি। তিনি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী এবং আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নির্বাচনী লড়াইয়ে একদিকে রয়েছেন ৭০ বছরের একজন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ও রিয়েলিটি টিভির হোস্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি শুধু বাগাড়ম্বর সম্বল করে এই নির্বাচনে নেমেছেন। প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রধান যোগ্যতা তিনি সফল ব্যবসায়ী। অবশ্য ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ঘায়েল করার ব্যাপক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে, সে বিষয়ে অবশ্য কোনো তথ্য কাউকে জানাননি। তিনি দাবি করেছেন, জেনারেলদের চেয়েও সমরবিদ্যা বিষয়ে তিনি বেশি জানেন। রাজনীতি বা সমরনীতি নিয়ে তিনি কারো সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, অপরের সঙ্গে কেন, নিজের সঙ্গে নিজে আলোচনা করেন। আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে জোর করে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। কীভাবে তিনি এ কাজ করবেন, তা পরিষ্কার করে বলেননি। তার দাবি, তিনি ১০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠানের মালিক। অথচ নিজের আয়কর হিসাব দাখিল করতে রাজি নন। সব ব্যাপারেই তার এক উত্তর, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন, সব হয়ে যাবে।’ নির্বাচনী লড়াইয়ের অন্য প্রান্তে রয়েছেন ৬৯ বছর বয়সী হিলারি ক্লিনটন। ৩০ বছর ধরে তিনি সারা বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত নারী রাজনীতিক। তিনি ফার্স্টলেডি, সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একবাক্যে স্বীকার করেন, তার মতো এত অভিজ্ঞ রাজনীতিক কখনো এই দেশের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হননি। ওবামা নিজেও সে কথা বলেছেন। তারপরও দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ তার প্রতি আস্থাহীন। নির্বাচিত হলে তিনি হবেন আমেরিকার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। অথচ কী আশ্চর্য, আমেরিকার মাত্র ৪৭ শতাংশ নারী তার প্রার্থিতা সমর্থন করেছেন।

১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার পর বিগত ২৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। এই প্রথম একজন নারী এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সেটা হবে আরেক ইতিহাস। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নারী আন্দোলন তথা নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে এটা হবে একটি মাইলফলক। পাঠকদের অজানা নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বড় অর্থনীতি ও বড় গণতন্ত্রের দেশ হলেও সেখানে নারীদের ভোটের অধিকারের বয়স মাত্র ৯৬ বছর। দীর্ঘদিন সেখানে নারীদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়নি। এমন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া আমেরিকার নারী আন্দোলনকে আরো উজ্জীবিত করছে, তাতে সন্দেহ নেই। এখানে আরো বলা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কনজারভেটিভ সোসাইটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব সীমিত। গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে কয়েকটি জরিপ তুলে ধরেছে। ২০১৫ সালের একটি পরিসংখ্যান বলে, কংগ্রেসে ৫৩৫টি আসনে (সিনেট ১০০, প্রতিনিধি পরিষদ ৪৩৫) মাত্র ১০৭ জন নারী আইন প্রণেতা রয়েছেন (ডেমোক্র্যাট ৭৬ জন, রিপাবলিকান ২৮ জন)। সিনেটে নারী প্রতিনিধি রয়েছেন ২০ জন (২০ শতাংশ), আর প্রতিনিধি পরিষদে রয়েছেন মাত্র ৮৪ জন (১৯.৩ শতাংশ)। সুতরাং এই সীমিত প্রতিনিধিত্বের মধ্য দিয়ে নারীর পূর্ণ অধিকার রক্ষিত হয়েছে, এটি বলা যাবে না। হিলারি ক্লিনটনের এই মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের নারী সমাজের জন্য বড় ধরনের একটি অগ্রগতি। ১৮৪৮ সালে সেনেকা ফলস কনভেনশনে প্রথমবারের মতো নারীদের ভোটাধিকারের দাবি জানানো হয়েছিল। আর ওই কনভেনশনের ১৬৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র এবার একজন নারী প্রার্থী পেল, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বিগত শতকের নব্বই দশকের শেষ দিকে মিখাইল গর্ভাচেভের হাত দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বে আমেরিকা একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দ্বি-মেরুকেন্দ্রিক স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর আন্তঃরাষ্ট্রীয় নির্ভরশীলতায় অনুন্নত, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বৈশ্বিক কিংবা আঞ্চলিক শক্তি, বৃহৎ কিংবা ছোট সব রাষ্ট্রই নিজ নিজ স্বার্থের হিসাব-নিকাশে আমেরিকার বিষয়টি মাথায় রাখে। এখানে আরো সহজভাবে বললে বলা যায় পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে আমেরিকাকে মাথায় রাখতে হয়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহের অনেক রাষ্ট্রেরই পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি আমেরিকান প্রশাসনের অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। আর বিশ্বব্যাপী আমেরিকান এই একচ্ছত্র প্রভাব বলয় নিয়ন্ত্রণ করে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী কার্যক্রমে প্রশাসনে ব্যক্তি অদল-বদল হয় বটে, তবে নীতি বদলায় না। বিশেষত আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির বদল, সেটা থাকে প্রায় স্থির। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের দু-একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দ যারা আশা করছেন, হিলারি নির্বাচিত হলে তাদের পালে হাওয়া লাগবে। কিংবা ট্রাম্প নির্বাচিত হলে আশায় গুড়েবালি, তারা অচিরেই বুঝতে পারবেন যে, আমেরিকায় প্রশাসন ও ব্যক্তি বদল হয় বৈকি, নীতি বদল হয় না।

নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি যে, ২০ জানুয়ারি একজন নতুন ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদকাল পার করছেন। তিনি ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বারাক ওবামার পূর্বসূরি হিলারির স্বামী ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে বিল ক্লিনটন দুই দফায় এবং তারও আগে রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ (বুশ জুনিয়র) দুই দফায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এবার আমেরিকা প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নতুন মুখ পাচ্ছে। হিলারি এবং ট্রাম্প প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছেন। হিলারি এবং ট্রাম্পের মধ্যে একজন নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট হলেও বিশ্ববাসী পুরোনো আমেরিকাকেই দেখবে। কারণ এ কথা স্বীকার্য যে, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বদল হলেও আমেরিকার নীতি বদল হয় না। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে, নতুন আমেরিকার মধ্যেই থাকে পুরোনো আমেরিকা।

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
Email: asumanarticle@gmail.com

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর