thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল 24, ৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ৭ শাওয়াল 1445

স্বাস্থ্য উৎসবে মেতে উঠে রমনার প্রতিটি ভোর

২০১৬ ডিসেম্বর ১০ ২১:১৫:৪৫
স্বাস্থ্য উৎসবে মেতে উঠে রমনার প্রতিটি ভোর

দিনের প্রথম আলো ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই রাতভর শিশির ভেজা ঘাসের আড়ষ্ঠতা ভাঙে কিছু মানুষের স্পর্শে। যেন নিষ্প্রাণ শহরের প্রাণ হয়ে থাকা কোমল সবুজ প্রান্তরটির ঘুম ভাঙে পাখির কলতান আর মানুষের কোলাহলে। এটা রাজধানী ঢাকার রমনা পার্ক।

আধো আলো আধো অন্ধকারে সেখানে শুরু হয় শিশু, তরুণ, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষের প্রতিদিনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উৎসব।

ভোর থেকেই ওয়াকওয়ে ধরে শত শত মানুষ ছুটতে থাকেন। মৃত্যুর নিশ্চিত নিয়তির পৃথিবীতে অমরত্বের বাসনায় নয়, একটু সুস্থ থাকার প্রত্যয়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে ৬৯ একরের এই পার্ক জুড়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে দিনে ব্যায়ামকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) ভোরে মৎস্যভবনের দিকের গেট দিয়ে প্রবেশ করেই দেখা গেল হাঁটার পথ ধরে ছুটছে শত শত মানুষ। কিছুটা এগিয়ে পাওয়া গেল কমান্ডারের কমান্ডের শব্দ, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একজনের কমান্ড মেনে ব্যায়াম করছে অন্যরা।

ব্যক্তিগতভাবে ছাড়াও এখানে প্রায় ১০ থেকে ১২টি সংগঠনের অধীনে সকালে ব্যয়াম হয়। পার্কের বিভিন্ন প্রান্তে এদের চোখে পড়বে।

কোথাও কোথাও দেখা গেল কেউ কেউ ব্যাডমিন্টন খেলছেন। কেউ কেউ দড়ি লাফ দিচ্ছেন। এমনকি চলছে ফুটবল খেলাও।

রমনায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করবে কোনো মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ। হরেক পাখির ডাকে শরীরের ক্ষতিকর চর্বি পোড়াতে পোড়াতে হয়তো এ শহরের দুর্ভোগের দুঃসহ স্মৃতিগুলো বিস্মৃত হয়ে যায় কারো কারো।

মুরব্বীরা ব্যায়ামের ফাঁকে ফাঁকে কনক্রিটের টুলে বসে জিরিয়ে নেন। ক্লান্ত হয়ে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মেতে উঠেন অনেকে। প্রতিদিনের অভ্যস্ততায় একটা পরিবারিক আবহ যে সচেতনভাবেই গড়ে উঠেছে, কোনো কোনো আড্ডার চিত্র দেখলেই তা বোঝা যায়। কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতেই সঙ্গী, বন্ধু কিংবা স্বজনের সঙ্গে দরকারি আলাপও সেরে নিচ্ছেন।

গণজমায়েত দেখে ব্যবসা ফাঁদার লোকও চোখে পড়বে রমনা পার্কে। হেয়ার রোডের দিকে অরুণোদয় ও মৎস্য ভবনের গেট দিয়ে প্রবেশ করে দেখ গেল টুল পেতে ডায়াবেটিস ও প্রেসার মাপানোর যন্ত্র নিয়ে বসে গেছেন কেউ কেউ। বড় বড় ব্যানার লাগিয়ে ক্যারিং ইন্ডিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান ভারতে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ বিলাচ্ছে।

পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, ব্যায়ামের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে উজ্জীবন, উজ্জীবন বাংলাদেশ, উৎস, শতায়ু অঙ্গন, রমনা উষা সংঘ, প্যানাশিয়া, আলফা ইয়োগা, প্রভাতী, মহিলা অঙ্গন, ক্ষণিকের মিলন ইত্যাদি।

পার্কের নিমতলায় ফ্রি-হ্যান্ড ও যোগব্যায়াম করে থাকে উজ্জীবন বাংলাদেশ। এ সংগঠনের চেয়ারম্যান হাজী মো. জজ মিয়া।

তিনি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সকালে অল্প হেঁটেই আমরা ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম শুরু করি। আমরা প্রতিদিন ৪০ ধরনের ফ্রি-হ্যান্ড ব্যয়াম করে থাকি। ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম শেষ করে মোনাজাতের পর যোগব্যায়াম হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম শরীরে চর্বি জমতে দেয় না। আমি ১২ বছর আগে রমনা পার্কে ব্যায়াম করতে শুরু করি। আমার শরীরে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল অনেক বেশি ছিল। ব্যায়াম করে আমার কোলেস্টেরল এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এটা ব্যায়ামের মাধ্যমেই সম্ভব।’

৪০টি ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের প্রায় সব অঙ্গের ব্যায়াম হয় বলেও জানান কেরাণীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জজ মিয়া।

এক সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন খান ১৯৯১ সাল থেকে রমনা পার্কে ব্যায়াম করেন। তার বয়স এখন ৬২ বছর, তিনি থাকেন রাজধানীর মগবাজারে। নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি ফজরের নামাজ পড়েই ব্যায়াম করতে পার্কে চলে আসি। ব্যায়ামের মাধ্যমে আমি এ সুস্থ আছি। আমার প্রেসার নেই, ডায়াবেটিস নেই। উপকারিতার জন্য সকালে পার্কে ব্যায়াম করা মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে হয়।’

নয়াপল্টন থেকে ১১ বছরের মেয়ে তাসমিয়া্ সরণিকাকে নিয়ে পার্কে ব্যায়াম করতে এসেছেন সালাহ্উদ্দিন মোস্তান মানিক। তিনি প্রিন্টিং প্রেসের ইঞ্জিনিয়ার।

মানিক বলেন, ‘এই শহরের মধ্যে রমনা পার্কে এলেই মাটির স্পর্শ পাই। এখানে আমি খালি পায়ে হাঁটি। প্রায় ১৫ বছর ধরে ব্যায়াম করছি এ পার্কে। আমি সুস্থ আছি।’

পার্কে দেখা মিলল জোছনা বেগমের। স্বাস্থ্য সুরক্ষা উৎসব আয়-উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে তার। তিনি ব্যায়ামের সরঞ্জাম দেখভাল করেন। জোছনা বলেন, ‘আমি ব্যায়ামের সময়ে পাটি বিছাইয়া দেই। আবার ব্যয়াম শেষ হলে গোছাইয়া আনসার ক্যাম্পে নিয়ে রাইখা দেই। আড়াই বছর ধরে আমি এ কাম করি। সব মিলাইয়া এই ভোরে কাম কইরা মাসে ৪ হাজার টাকা পাই।’

লেকে মাছ ধরার মচ্ছব

রমনা পার্কের মধ্যে ৮ দশমিক ৮৬ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে লেক। ৯ মিটার থেকে ৯৪ মিটার প্রস্থের এ লেকটি ৮১২ মিটার লম্বা। টিকেট কেটে লেকে সৌখিন মৎস্য শিকারীদের বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার।

প্রতি শুক্র ও শনিবার ভোর থেকেই মৎস্য শিকারীরা লেকের পাড়ে সারি ধরে বসে যান। পানিতে বড়শি ফেলে ধ্যানীর মতো বসে থাকেন। তবে লেকে মাছ ধরার মচ্ছব শেষ হয়ে গেল শনিবার।

শুক্রবার নগর গণপূর্ত বিভাগের কার্যসহকারী শামসুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘গত ১৮ নভেম্বর থেকে শুক্র ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কেটে কেউ একদিন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। তবে এ সুযোগ শনিবারই (১০ ডিসেম্বর) শেষ হলো।

প্রতিদিনই ৩০ থেকে ৪০ জন মৎস্য শিকারী মাছ ধরছেন বলেও জানান তিনি।

একটি ডেভেলপার কোম্পানির পরিচালক একেএম গোলাম ফেরদৌস লেকের পশ্চিম তীরে বসে মাছ ধরছিলেন। তিনি বলেন, ‘বড়শি দিয়ে মাছ ধরার কাজটি একই সঙ্গে সৃজনশীল, নেশা ও মহা আনন্দের। এটা বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সিজন নয়। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে হয় বর্ষাকালে। তারপরও সরকার সৌখিন মৎস্য শিকারীদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এটা খুবই ভাল। কারণ ধামমন্ডি লেকেও মাছ ধরার সুযোগটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

শুরুর দিন ১৮ নভেম্বর গোলাম ফেরদৌস একটি বড় আকারের রুই মাছ পেয়েছিলেন বলেও জানান।

হাতিরঝিলের একটি অংশে মাছ ছেড়ে এ ধরনের সুযোগ করে দিলে বিনোদনের সঙ্গে সরকারের আয় বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন ফেরদৌস।

আলু বাজারের ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন এসেছেন মাছ ধরতে। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, “এটা সরকারের খুবই ভাল উদ্যোগ। এটা চালু থাকা দরকার। তবে টিকেটের দামটা একটু বেশি হয়ে গেছে। পনের শ’ থেকে দুই হাজার হলে ভাল হয়।”

রমনার কিছু তথ্য

সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, রমনা ১৯৪৯ সালে পার্ক হিসেবে মর্যাদা পায়। তখন এতে ৭১ প্রজাতির গাছ ছিল। বর্তমানে এখানে ২১১ প্রজাতির গাছ রয়েছে।

পার্কটির মোট আয়তন ৬৮ দশমিক ৫০ একর।

তবে ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, এই উদ্যানটি ১৬১০ সালে মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ে রমনার পরিসীমা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। মোঘলরাই রমনার নামকরণ করেন। পুরানো হাইকোর্ট ভবন থেকে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মোঘলরা বাগান তৈরি করেছিলেন।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/জেডটি/ডিসেম্বর ১০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর