thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

দালালদের দৌরাত্ম্য বিদেশেও

বাহরাইন ডিপোর্টেশন সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ৫০ বাংলাদেশি বন্দি

২০১৬ ডিসেম্বর ১৩ ২৩:২৪:৩৭
বাহরাইন ডিপোর্টেশন সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ৫০ বাংলাদেশি বন্দি

বাহরাইনের ইমিগ্রেশন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টারে (কারাগার নয়) প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। অবৈধভাবে বসবাসসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে দেশেটির আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে এ বন্দিজীবন বরণ করতে হয় তাদের। তারা অপেক্ষায় থাকেন দেশে প্রত্যাবর্তনের। এদের কেউ কেউ অবশ্য বৈধ কাগজপত্র বানিয়ে বা বানাতে সক্ষম হয়ে সেদেশেই থেকে যান। অন্যদিকে, যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দেশে ফেরা বাধ্যতামূলক। তাই বেশিরভাগই সাজার মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে আসেন। তবে সেখানকার স্থানীয় কথিত আইনজীবী ও দালালদের প্ররোচনায় শাস্তিশেষে অনেকেই আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টারেই দিন কাটান বৈধ হওয়ার আশায়।

বাহরাইনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মোঃ মুহিতুল ইসলাম এসব তথ্য দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি সোমবার (১২ ডিসেম্বর) এই প্রতিবেদককে টেলিফোনে বলেছেন, ‘আজকের (১২ ডিসেম্বর) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাহরাইনের ওই ডিপোর্টেশন সেন্টারে ৭৫ জন বাংলাদেশি বন্দি রয়েছেন। বন্দিদের বেশিরভাগই প্রতিদিন পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ শাস্তি শেষে এক গ্রুপ বেরিয়ে যায়, প্রায় একই সংখ্যক বাংলাদেশি আবার নতুন করে সেখানে প্রবেশ করে। ডিপোর্টেশন সেন্টারটিতে গড়পড়তায় প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন বাংলাদেশি বন্দি থাকছেন।’

এক সপ্তাহ আগে শ্রম কাউন্সেলর বলেছিলেন, ‘আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টারে ৮৫ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। বেশিরভাগই অল্প দিনের জন্য থাকেন। এরপর বেরিয়ে যান। এই দেখবেন আজ ২৫-৩০ জন চলে গেছে, আবার প্রায় একই পরিমাণ বাংলাদেশি শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে ঢুকেছেন।’

মুহিতুল ইসলাম আরও বলেছেন, ‘অনেকেই আছেন, যাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও তা নবায়ন না করে অবৈধভাবে বসবাস করার অবস্থায় পুলিশের কাছে গ্রেফতার হন। এ ছাড়া এখানে (বাহরাইনে) যিনি যে কাজের জন্য এসেছেন, তাকে সেই কাজই করতে হবে। যে মালিকের কাজ করেন, তার অধীনেই কাজ করতে হবে। এর বাইরে অন্য মালিকের বা অতিরিক্ত কাজ করা যাবে না। অনেকেই আছেন যে তার মালিক থেকে পালিয়ে অন্য জায়গায় কাজ করছেন বা মালিকের কাজ শেষে অন্য জায়গায় অতিরিক্ত কাজ করছেন। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর এসব প্রবাসী কর্মীকে আদালতে তোলা হয়, আদালতে তাদের বিভিন্ন হারে আর্থিক জরিমানা করে আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টারে পাঠানো হয়। এর বাইরে পতিতাবৃত্তি, পতিতার ব্যবসা, জুয়া, মাদক ব্যবসাসহ এ ধরনের কিছু গর্হিত অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েও বেশ কিছু বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরে ওই ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থান করছেন।’

জরিমানা দিয়ে কেউ ফিরে যান, কেউ থেকে যান

শ্রম কাউন্সেলর জানান, ছোট ছোট অপরাধে (যেমন ভিসার মেয়াদ নাই) শাস্তি পান অনেকেই। ভিসার ক্ষেত্রে নিয়ম হলো মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই নাবায়ন করা; কিন্তু এটা অনেকে না করার কারণে ধরা পড়ে। এই ধরনের ব্যক্তিকে রাখার জন্য যদি নতুন স্পন্সর (নিয়োগকর্তা) কোর্টে গিয়ে বলেন যে, তাকে তিনি রাখতে চান, তাহলে ৩-৬ মাসের মধ্যে তার ভিসা হয়ে যায়। তিনি থেকে (বাহরাইন) যান। অনেক সময় আমরাই (দূতাবাস) স্পন্সর যোগার করে দেই। অনেক সময় আবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজের কোয়ালিটির সঙ্গে মিল না থাকায় বা ব্যক্তির যোগ্যতা না থাকায় স্পন্সর পাওয়া না। তখন তো আমাদের কিছু করার থাকে না, তাকেও দেশে চলে যেতে হয়। আর যারা ক্রিমিনাল কেসে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে ঢোকেন তাদের দেশে ফিরে যেতেই হয়। তাদের আর বাহরাইনে থাকার সুযোগ নেই।

বাহরাইনেও দালাল চক্র

মুহিতুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা কিন্তু আমাদের মারাত্মকভাবে অনেক সময় অসহযোগিতা করেন। তাদের অনেকেই নানা অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে আছেন। শাস্তিপ্রাপ্ত কাউকেই রাখবে না বাহরাইন সরকার। শুধু তাই নয়, জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে (বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, ওমান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) আগামী ৩ বছর তারা (ক্রিমিনাল কেসে শাস্তিপ্রাপ্ত) কেউ ঢুকতে পারবে না। এসব দেশে কমন ডাটাবেজ আছে। অর্থাৎ ক্রিমিনাল কেস যাদের আছে তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু এখানে (বাহরাইন) কিছু আইনজীবী আছেন, দালাল আছে। ক্রিমিনাল কেসে অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের মিথ্যা আশ্বাস দেন যে থাকেন-থাকেন ব্যবস্থা হবে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জেলখানা যেমন কষ্টের জায়গা, সবাই সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য হাসফাঁস করে, আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টার তেমনটা না। এখানে নিয়মিত খাবার দিচ্ছে, বাইরে থেকে কিনে খেতে পারছে। অনেকেই শাস্তি শেষ হওয়ার পরও ডিপোর্টেশন সেন্টারে বসে থাকে। ওরা মনে করে কোনো না কোনোভাবে তারা বের হয়ে সেখানেই (বাহরাইনে) আবার ভিসা নিয়ে কাজ করতে পারবেন। আমরা যতই বলি তুমি এদেশে থাকতে পারবে না, এরা আমাদের কথা শোনে না। এরা যেতে চায় না।’

গত ২০ নভেম্বর ‘বাহরাইনের কারাগারে আটকে গেছে অর্ধশত বাংলাদেশির স্বপ্ন’শিরোনামে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সংবাদের বিষয়টি বাহরাইনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে অবহিত করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। গত ২৭ নভেম্বর ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওই চিঠির জবাবে বলা হয়, ‘আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বা গর্হিত অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্তদের এদেশে বৈধভাবে থাকার ব্যবস্থা করায় আমরা অপারগ। বিষয়টি বাহরাইন ইমিগ্রেশন ও দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদেরকে (আটক বাংলাদেশি) বারবার পরিষ্কারভাবে জানানো হলেও কিছু অসাধু দালাল ও স্থানীয় অসাধু আইনজীবীর মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে তারা অর্থ নষ্ট করে চলেছেন এবং ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থান করছেন। গত ২৪ নভেম্বর সকালে একজন বাংলাদেশি বন্দির দেশে ফিরে যাওয়ার বিমানের টিকেট প্রদান করা হলেও তিনি শেষ মুহূর্তে দেশে যেতে অস্বীকৃতি জানান। বাহরাইনের আইনে জোরপূর্বক কাউকে দেশে প্রেরণের নিয়ম নেই। তবে তারা এদের বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে দূতাবাসকে জানিয়েছে, এরূপ একজন বন্দির জন্য তাদের সরকারকে প্রতিদিন ৮ দিনার তথা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৭০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।’

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘দূতাবাস থেকে স্বল্প জরিমানাকৃত ব্যক্তিদের জরিমানা পরিশোধ, পাসপোর্টবিহীন অসচ্ছল ব্যক্তিদের আউটপাসের ফি পরিশোধ পূর্বক আউটপাস প্রদান ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের বিমানের টিকেট প্রদান করে থাকে। গত নভেম্বর মাসে আলবা ডিপোর্টেশন সেন্টারের ৭ জনকে এরূপ সহায়তা করে বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের বিমানের টিকেট ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের বাজেট থেকে বহন করা হয়েছে।’

প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন জানিয়ে বাহরাইনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানান, ডিপোর্টেশন সেন্টারে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে ইমিগ্রেশন বিভাগ দূতাবাসকে নিয়মিত তথ্য প্রদান করে থাকে এবং দূতাবাস থেকেও তাদের বিষয়াদি নিয়মিত অনুসরণ করা হয়। রাষ্ট্রদূত ও কাউন্সেলর (শ্রম) ছাড়াও বাংলাদেশি কর্মীদের এ জাতীয় সমস্যা নিরসের জন্য দূতাবাসে একজন নিবেদিত কর্মচারী রয়েছেন।

তিনি আরও জানান, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে বাহরাইনে ভিজিট বা ট্রানজিট ভিসায় খুব কম লোক আসে। ভারত ব্যতীত বাহরাইনে অন্যান্য দেশের জনসংখ্যা খুবই কম এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও অনেক কম। প্রতি সপ্তাহেই বাহরাইনের জেলখানা ও ডিপোর্টেশন সেন্টার পরিদর্শনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান এ শ্রম কাউন্সেলর।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এনআই/ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর