thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বছর জুড়ে বীমা খাতে দুদক আতঙ্ক

২০১৬ ডিসেম্বর ২৯ ২৩:৩৩:৩০
বছর জুড়ে বীমা খাতে দুদক আতঙ্ক

জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর মাত্রারিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উদ্যোগ নেওয়ায় ২০১৬ সাল জুড়েই আতঙ্কের মধ্যে ছিল দেশের বীমা খাত।

বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়ম ক্ষতিয়ে দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তও ছিল বেশ প্রসংশনীয়।

তবে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় ব্যপক দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে আসলেও কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইডিআরএ’র ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও একটি কোম্পানির বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এমনকি দুদক থেকে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে পদক্ষেপ নেওয়া হলে, হঠাৎ করেই কোম্পানিগুলোর পক্ষ নেয় আইডিআরএ।

অথচ দুদকের পদক্ষেপের আগে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করা অবৈধ। এ ব্যয়ের কারণে কোম্পানির গ্রাহকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

আইডিআরএ’র এমন ভূমিকার পাশাপাশি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ও সদস্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদের শেয়ার ব্যবসায় জড়িত থাকা, দুর্নীতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পদে অব্যহত রাখা, জনবল নিয়োগ কাঠামো, আইনের প্রবিধান না হওয়া, আইনের তোয়াক্কা না করেই ভারতের বৃহৎ জীবন বীমা কোম্পানি এলআইসিকে বাংলাদেশে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার মতো ঘটনাও ছিল ২০১৬ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

এর সঙ্গে বরাবরের মতো গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অবৈধভাবে অর্থ খরচ, ভূয়া এজেন্ট, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসাসহ সকল ধরনের দুর্নীতি আর অনিয়ম অব্যহত ছিল বছর জুড়েই।

মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএতে দক্ষ জনবলের অভাব ও উচ্চ পদে নিয়োগে অনিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই বছরজুড়ে বীমা খাতে অস্থিরত বিরাজ করেছে।

অথচ নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বীমা খাতের দুর্নীতি দূর করে উন্নয়ন করা। এ জন্য দুর্নীতিপরায় সাবেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা অধিদফতর বিলুপ্ত করে ২০১১ সালে আইডিআরএ গঠন করা হয়।

কিন্তু বীমা খাতের দুর্নীতি দূর করার বদলে উল্টো নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিও ছাড়িয়ে গেছে আইডিআরএ। এ বিষয়গুলোও বছরজুড়ে বীমা কর্মকর্তাদের আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে।

দুদক আতঙ্ক

জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অবৈধ ব্যয় নিয়ে দুদকের কাছে একটি অভিযোগ পমা পড়ে। ওই অভিযোগে বলা হয়ে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে অবৈধভাবে ১৭টি কোম্পানি ব্যয় করেছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার শতকরা ৯০ ভাগ টাকা গ্রাহকের।

এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৮ জুন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে রেকর্ডপত্র চেয়ে দুদক থেকে চিঠি দেওয় হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় একাধিক বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে। এরপরই বীমা খাতে দুদক আতঙ্ক ছড়ি পড়ে। বীমা মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রণালয় ও আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করা হয়।

বীমা মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকের পর অদৃশ্য কারণে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের পক্ষে অবস্থান নেয় আইডিআরএ। যে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে অবৈধ ব্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল, সেই আইডিআরএ’র পক্ষ থেকেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় মানে আত্মসাৎ নয়।

স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ

অনিয়মের কারণে ২০১৫ সালে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল করে আইডিআরএ। পুনঃবীমায় অনিয়ম করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন সনদ বাতিল করা হয়। দেশীয় সংবাদ মাধ্যমের পাশপাশি আন্তুর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যমতে এটি ছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বীমা খাতের ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে কখনো এশিয়া মহাদেশে অনিয়মের কারণে কোনো বীমা কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল হয়নি। তবে বছর না ঘুরতেই স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স’র নিবন্ধন সনদ ফিরিয়ে দিয়েছে সরকার। মূলত আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদের ভূমিকার কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স’র নিবন্ধন সনদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

দুর্নীতির অভিযোগ থাকা ব্যক্তি উপদেষ্টা

প্রগ্রেসিভ লাইফের কর্মকর্তা এনায়েত আলী খানকে ২০১৫ সালে আইডিআরএ’র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিশেষ পছন্দভাজন হওয়াই কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে ২০১৬ সালেও এনায়েত আলী খান আইডিআরএ’র উপদেষ্টা হিসেবে বহাল তবিয়তে থাকেন।

অথচ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। তিনি অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে প্রগ্রেসিভ লাইফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা চলমান রয়েছে।

গৃহদ্বন্দ্বে আইডিআরএ

আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। প্রথম ধাপে নিয়োগ দেওয়া সদস্যদের বিদায় করে দেওয়ার পরও চলতি বছরে সেই দ্বন্দ্ব অব্যহত আছে। এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই অর্থমন্ত্রণালয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগও করেছেন। দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের কারণে সদস্যদের কাছ থেকে সকল ফাইল সরিয়ে নিজের জিম্মায় নিয়েছেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান।

নেই আইনের প্রবিধান

বিমা আইন পাশের পর একে একে ৬টি বছর পার হলেও তৈরি করা হয়নি আইনের অধিকাংশ বিধি ও প্রবিধানমালা। অথচ এই বিধি ও প্রবিধানমালা হলো আইনের ব্যাখ্যা, অর্থাৎ বিধি ও প্রবিধানমালা ছাড়া আইন মূলত অকার্যকর।

হয়নি লোকবল নিয়োগ

কয়েক দফা চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়ে বিদায়ী বছরে আইডিআরএ’র জনবল নিয়োগের চুড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে এই অনুমোদনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ভাড়া করা (চুক্তি ভিত্তিক) লোকবল দিয়েই চলছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিতে এ অবস্থা বিরাজ করছে।

নিরীক্ষক নিয়োগ

ব্যবস্থাপনা খাতে মাত্রাতিরিক্ত এমন ব্যয়ের কারণে প্রাথমিকভাবে জীবন বীমা কর্পোরেশন, পদ্মা ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, মেঘনা লাইফ, প্রগতী লাইফ ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্সে নিরীক্ষক নিয়োগ করে আইডিআরএ। নিরীক্ষা কার্যক্রম শেষে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। তবে অদৃশ্য কারণে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আইডিআরএ।

এলআইসির অনুমোদনে অনিয়ম

আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই ভারতের বৃহত্তম জীবন বীমা কোম্পানি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এলআইসি)-কে ‘লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশ’ নামে বাংলাদেশ ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে আইডিআরএ।

লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি বীমা কোম্পানি হলেও প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ভারতের এলআইসি থেকে ডেপুটেশনে আসা অরুপ দাস গুপ্ত। অথচ বাংলাদেশের বীমা আইন অনুযায়ী এক কোম্পানির কর্মকর্তাকে ডেপুটেশনে অন্য কোম্পানির সিইও করার কোনো সুযোগ নেই।

আবার দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার এই বীমা কোম্পানিটি যেসব পণ্য বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে তাও অবৈধ। কারণ আইডিআরএ প্রতিষ্ঠানটির যে ৫টি পরিকল্প অনুমোদন দিয়েছে তার কোনোটিই বাংলাদেশের জন্য বৈধ অ্যাকচুয়ারি দ্বারা স্বীকৃত না। ৫টি পরিকল্পই ভারতের এলআইসির। অথচ বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা করা কোম্পানির পরিকল্প আইডিআরএ থেকে অনুমোদন নেওয়া অ্যাকচুয়ারি কর্তৃক স্বীকৃত হতে হয়।

(দ্য রিপোর্ট/এসএস/জেডটি/ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর