thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বাংলাদেশি কর্মীর অপেক্ষায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা

২০১৭ জানুয়ারি ০৮ ২২:৩৮:০৬
বাংলাদেশি কর্মীর অপেক্ষায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা

বাংলাদেশ থেকে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতি বা সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কর্মী আনতে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার কর্মী নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করলেই যেকোনো দিন বাংলাদেশ থেকে কলিংভিসায় কর্মী আসা শুরু হবে দেশটিতে। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো (কলকারখানা, এগ্রিকালচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান) পক্ষ থেকে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে সে দেশের সংশ্লিষ্ট দফতরে চাহিদাপত্র দিতে শুরু করেছে। অনেক কোম্পানির মালিক আবার কর্মী নেওয়ার চাহিদাপত্র প্রস্তুত করে রেখেছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন কোম্পানি ও কলকারখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিদেশি কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি অনেক আন্তরিক। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশিদের চাহিদা একটু বেশিই। কিন্তু দীর্ঘদিন দেশটি বাংলাদেশিদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখায় মাঝে সেখানে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ স্থিমিত হয়ে পড়ে।

উভয় দেশের মধ্যে গত বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি সম্পাদিত ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির আলোকে মালয়েশিয়ায় নতুন করে বিপুলসংখ্যক কর্মী আনার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি করে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য চাহিদাপত্র তৈরি করছেন, অনেকে আবার সংশ্লিষ্ট দফতরে জমাও দিচ্ছেন।

সরেজমিনে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের জাহান রাজা চুলান এলাকায় (নিলাই জেনারেল প্লান্ট) অবস্থিত ভারতের বৃহৎ শিল্প পরিবার রিলায়েন্স গ্রুপের ‘রিক্রন মালয়েশিয়া এসডিএন বিএইচডি’ নামে একটি টেক্সটাইল কারখানায় গিয়ে কথা হয় রিক্রনের নিলাই ইউনিটের পরিচালক (উৎপাদন) হেমন্ত এম. রাজে এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান অমিত কে. সাক্সেনার সঙ্গে। তারা জানান, বর্তমানে এ কারখানায় কাজ করছেন ৬ হাজার ৮শ’ শ্রমিক। যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। যেখানে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শার্ট, প্যান্টসহ অন্যান্য পোশাক তৈরির (কটন, লাইলন, পলিয়েস্টার) কাপড়। যা মালয়েশিয়ায় ব্যবহৃত হওয়াসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।

অমিত কে. সাক্সেনা বলেন, তাদের আরও কমপক্ষে এক হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন। এ জন্য তারা ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে চাহিদাপত্রও দিয়েছেন। এখন শুধু অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশ থেকে কবে নাগাদ কলিংভিসায় (জিটুজি প্লাস) কর্মী আসা শুরু করবে। কলিং শুরু হলেই কারখানাটিতে চাহিদা মোতাবেক শ্রমিক নেবেন তারা।

রিক্রনের নিলাই ইউনিটের পরিচালক (উৎপাদন) হেমন্ত এম. রাজে বলেন, বাংলাদেশি কর্মীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও তার কাজের প্রতি আন্তরিক। তাই, তাদের অনেক চাহিদা রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় আমরা বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করতে পারিনি।

তিনি বলেন, একসময় রিক্রনের মালয়েশিয়ায় তিনটি ইউনিটে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার কর্মী ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে কর্মীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে গেছে। এসব কর্মীর স্থানে নতুন করে বাংলাদেশিদের নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ রিক্রন বা রিলায়েন্স, কেউই কোনো অবৈধ শ্রমিক নিয়োগ করে না। ফলে বর্তমানে তিনটি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা মাত্র দুই হাজারে নেমে এসেছে। হেমন্ত এম. রাজে বলেন, আগামীতে বাজার খুললে সরকার আমাদের বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দেবে বলে আশা করছি।

মালয়েশিয়ার বন্দর পুত্রা এলাকার কেনিয়াল মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট সাপ্লায়ার্স নামে মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট সাপ্লাই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিওনার্দো লউইস জানান, পরিশ্রম ও সততার বিবেচনায় বাংলাদেশি কর্মীরাই তার পছন্দ। তার কারখানায় কমপক্ষে ৫শ’ কর্মী লাগবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসা শুরু হলে কর্মীর এ চাহিদা পূরণ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সেক্টরে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক আনার জন্য বিদায়ী ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চুক্তি করেছে মালয়েশিয়া। এ চুক্তির আলোকে বিপুল সংখ্যক মানুষ শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় আসার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। মালয়েশিয়ার চাহিদা মতো কর্মী পাঠাতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও। ঠিক তেমনি অপেক্ষায় রয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিল্প কারখানার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা মালিকরাও। ‘রিক্রন মালয়েশিয়া এসডিএন বিএইচডি’ কারখানা ও ‘কেনিয়াল মেডিকেল ইক্যুপমেন্ট সাপ্লায়ার্স’ কর্তৃপক্ষের মতো মালয়েশিয়ার আরও অসংখ্য ছোট-বড় কলকারখানার মালিক অপেক্ষায় রয়েছে, কবে নাগাদ বাংলাদেশের কলিংভিসা খুলে দেওয়া হবে। কলিংভিসায় লোক আসা শুরু হলেই এসব কোম্পানি তাদের চাহিদা মতো শ্রমিক নেবে।

‘রিকর্ন মালয়েশিয়া এসডিএন বিএইচডি’ টেক্সটাইলে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মী জামাল উদ্দিন। ২০০৭ সাল থেকে সেখানে কাজ করছেন তিনি। কুমিল্লার লাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জামাল জানান, টেক্সটাইল কারখানাটিতে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি রয়েছে। তবে কয়েকবছর আগে এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ছিল। নানা কারণে কারখানাটিতে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা কমেছে। টেক্সাইলটিতে মিয়ানমার, নেপাল, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের সংখ্যা বাংলাদেশের পরেই। বেতন তুলনামূলক কম পেলেও কারখানাটিতে তারা নিয়মিত ভাতা পান বলে জানান তিনি।

শুধু কলকারখানা নয়, এগ্রিকালচার, কনস্ট্রাকশন ও ম্যানুফেকচারারসহ বিভিন্ন সেক্টরেও প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে মালয়েশিয়ায়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার দ্য স্ট্রেইট টাইমসের এক বিশ্লেষণে জানা যায়, শ্রমিক সঙ্কটের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম ও জনপ্রিয় মালয়েশিয়ার ফার্নিচার শিল্পখাতে প্রতি মাসে শিপমেন্ট ২৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফার্নিচার খাতে ২৭ হাজার কর্মীর অভাব রয়েছে দেশটিতে। এ ছাড়া কৃষি কাজের উদ্যোক্তারা স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে কৃষি কাজ করাতে পারছেন না। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন না হওয়ায় মালয়েশিয়ার ফলের মূল্য প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

মালয়েশিয়ার ম্যানুফেকচারার ফেডারেশন জানিয়েছে, সংস্থাটির ৮৪ ভাগ সদস্য জনশক্তি সংকটে রয়েছে। অর্ধেক প্রতিষ্ঠান অর্ডার পূরণ করতে পারছে না। শ্রমিকের অভাবে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে উদ্যোক্তারা।

মালয়েশিয়া এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক আমদানির দেশ। উন্নত অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও ভালো বেতন সরবরাহ করার কারণেই আঞ্চলিক অনেক দেশের চেয়ে শ্রমিক আমদানিতে এগিয়ে। এ ছাড়া ডার্টি, ডেনজারাস ও ডিফিকাল্ট (থ্রিডি) কাজ মালয়েশিয়ার স্থানীয়রা করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কৃষি কাজ, নির্মাণ ও ম্যানুফেকচারিং কাজেও মালয়েশিয়ার স্থানীয়দের তেমন আগ্রহ নেই। মালয়েশিয়ার একটি প্রদেশে পামওয়েল খাতে বছরে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। কারণ পাম ওয়েলে কাজ করার মতো স্থানীয় বা বিদেশি যথেষ্ট শ্রমিক নেই। শ্রমিক সংকটের কারণে পাম চাষ করা যাচ্ছে না। ফলে দেশটিতে ব্যাপক বিদেশি শ্রমিকের অভাব রয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বিগত ২০০৭ ও ২০০৮ সালে অনুমোদিত ভিসার বিপরীতে অনেক অবৈধ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় ঢুকে পড়ায় দেশটির সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের শেষদিকে সরকারি পর্যায়ে কর্মী প্রবেশের শর্তে বাজারটি খুললেও কৃষিখাতে মাত্র ৮ হাজার কর্মী দেশটিতে ঢুকতে পারে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী নিতে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ রেখে ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তি সই করে উভয় দেশ। চুক্তি সইয়ের পরের দিন মালয়েশিয়া সরকারের বিদেশি কর্মী না নেওয়ার ঘোষণায় নানা জটিলতা তৈরি হয়। তবে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে সেটির।

উভয় দেশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো সময়ই বাংলাদেশ থেকে ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির আলোকে কর্মী আসা শুরু হবে মালয়েশিয়ায়। মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে অনেক কর্মীরা যেমন ভাল বেতনে কাজ করার সুযোগ পাবেন। তেমনি মালয়েশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেশেও অভিবাসন ব্যয় কমে আসবে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/জেডটি/এনআই/জানুয়ারি ০৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর