thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

কারিগরি প্রস্তুতি সম্পন্ন

নতুন পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সময় লাগবে দুই সপ্তাহ

২০১৭ জানুয়ারি ০৯ ২১:৫৪:০২
নতুন পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সময় লাগবে দুই সপ্তাহ

‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল বা অনলাইনের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ হবে মালয়েশিয়ায়। কর্মীর বায়োমেট্রিক পরীক্ষার পর অনলাইনে কর্মী ভিসা প্রসেস করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। বর্তমান ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে একজন কর্মীর নিয়োগে ৩ থেকে ৯ মাস সময় লাগলেও নতুন এ পদ্ধতিতে দুই সপ্তাহের মধ্যেই সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মীও নিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নতুন এ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগের কারিগরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে সিনারফ্লাক্স ও বেস্টিনেট নামে মালয়েশিয়ার দুটি কোম্পানি। এ দুটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কর্মী নিয়োগে চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কর্মী পাঠাতে গড়ে উঠেছে দালালচক্র। বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহের পর থেকেই দালালচক্র দফায় দফায় টাকা নিচ্ছে। কোনো কোনো সময় রিক্রুটিং এজেন্সির কাছেও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন কর্মীরা। মেডিক্যাল আর বহির্গমন ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় ওই চক্র। দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে কর্মীরা বিভিন্ন দেশে মানবতার জীবনযাপনের ঘটনা বহু পুরনো। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতেও দালালচক্রের থাবা রয়েছে। মোটা অংকের টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় এসে প্রতিশ্রুত চাকরি পাওয়া তো দূরের কথা অনেকের ঠাঁই হয়েছে বনে-জঙ্গলে। ব্রিজের নিচে ও ফুটপাতে রাত কাটানোর ঘটনাও রয়েছে। এসব প্রতারণার কারণে দেশের অন্যতম এ শ্রমবাজারটি কয়েকবার বন্ধও হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে যেমন এর খেসারত দিতে হয়েছে, তেমনি মালয়েশিয়া সরকারও ওই ঘটনায় বিব্রত রয়েছে।

এ অবস্থায় উভয়দেশের সরকার মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কোনোভাবেই যাতে দালালচক্র সুবিধা না করতে পারে সেজন্য ম্যানুয়াল বা পুরনো পদ্ধতি বাদ দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে কর্মী বাছাই এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে এবার।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে শতভাগ অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী নেওয়ার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে উভয় দেশ। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির আলোকে সম্পূর্ণ অনলাইনে কর্মী নিয়োগ হবে মালয়েশিয়া। এজন্য মালয়েশিয়া সরকার সেদেশের ৫টি প্রতিষ্ঠানকে কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনুমোদন দিয়েছে। বেস্টিনেট, সিনারফ্ল্যাক্স, ইউকেএসবি, এস-ফাইভ, বায়োটেক নামের পাচঁটি প্রতিষ্ঠান তদের কর্মী নেওয়ার সকল কাজ সম্পন্ন করেছে ইতোমধ্যে।

সরেজমিন গিয়ে সিনারফ্লাক্স ও বেস্টিনেট নামে মালয়েশিয়ান দু’টি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোট ১২ ধাপ অনুসরণ করে বাংলাদেশ থেকে অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী নেওয়া হবে। আর অনলাইন প্রক্রিয়ায় কর্মী নেওয়া শুরু হলে জালিয়াতি আর অনিয়মের কোন সুযোগ থাকছে না। অভিবাসন ব্যয় কমে যাওয়ার পাশপাশি মালয়েশিয়ায় এসে কর্মীরা কাজের নিরাপত্তা, বীমা সুবিধাসহ আইএলও সকল সুযোগ সুবিধা পাবে।

মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিনিধিরা জানান, অনলাইন প্রক্রিয়ার প্রথমেই মালয়েশিয়ায় কোনো কোম্পানি কিংবা কারখানার মালিক কর্মীর চাহিদাপত্র অনলাইনে তাদের সরকারের কাছে আবেদন করবেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরা কারখানার বাস্তবতা যাচাই করে রিপোর্ট দিবে এবং চাহিদাপত্র ঠিক হলে মালয়েশিয়ান সরকার কর্মী নেওয়ার অনুমোদন দিবে। এরপর মালয়েশিয়ার সরকারই কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে মনোনীত করবে। পরে সেই চাহিদাপত্র বাংলাদেশে মালয়েশিয়ান দূতাবাসে যাবে। মনোনীত রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী বাছাই, মেডিক্যালসহ ১২টি ধাপ পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়া হবে।

শুধু বাংলাদেশ নয়-একই পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ার অন্য ১৫টি সোর্স কান্ট্রি থেকেও কর্মী নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে মালয়েশিয়া সরকারের কারিগরি সহায়তাকারী দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে কয়টি প্রতিষ্ঠান কর্মী পাঠাবে সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। সেটা দেখবে উভয়দেশের সরকার। এটা অন্য কারো নির্ধারণ করার সুযোগ নাই। মূলত প্রতারণা ও জালিয়াতি বন্ধ করা এবং প্রবাসীকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই উভয় সরকার এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

শ্রমবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্মীও চাহিদাপত্রে যদি ২০০ জন লেখা থাকে, জালিয়াতচক্র তাতে একটি শুন্য বসিয়ে দিয়ে দুই হাজার সংখ্যা বানিয়ে অতিরিক্ত শ্রমিক সংগ্রহ করে। এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করার অহরহ ঘটনা রয়েছে। কিন্তু নতুন বা অনলাইন পদ্ধতিতে এ প্রতারণার কোনো সুযোগ নেই। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তার চাহিদাপত্রে কর্মীর চাহিদা যত থাকবে ঠিক সেই সংখ্যার কর্মীই আসবে। জালিয়াতি করে বেশি কর্মী আনা বা নেওয়ার সুযোগ পাবে না দালালরা।

বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনতে কারিগরি সহায়তাকারী বেস্টিনেট ও সিনারফ্লাক্স-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী মালয়েশিয়া এলে প্রথমে তিন বছরের জন্য ভিসা দেওয়া হবে। পরে এক বছর করে ৫ বছর মালয়েশিয়ায় থাকতে পারবেন তারা। ভিসা নবায়ন ফি মালিকপক্ষ বহন করবে। মালিকপক্ষ চাইলে কর্মীরা সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কোম্পানিতে কাজ করতে পারবে। অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো হলে কর্মীর অভিবাসন ব্যয় প্রায় অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। মালিকপক্ষের ডিমান্ড লেটার ইচ্ছা করলেই কেউ বিক্রি করতে পারবে না। এখন সঠিক প্রক্রিয়ায় মেডিক্যাল হবে, ভুয়া মেডিক্যাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর মেডিক্যাল করার জন্য ২৫টি সেন্টার নির্মাণ করা হবে। আর একজন কর্মী বিদেশ যেতে ৬ মাস থেকে ৯ মাস অপেক্ষা করতে হবে না। দুই সপ্তাহের মধ্যেই অনলাইন প্রক্রিয়ায় কর্মী যেতে পারবে। আগে ৩৫ থেকে ৪০ভাগ কর্মীর কোন বীমা ছিলো না, এখন শতভাগ বীমা নিশ্চিত করা হবে কর্মীদের। বীমা না হলে কর্মী নেওয়া সাপোর্ট করবে না অনলাইন প্রক্রিয়া। আর আগে কর্মী মারা গেলে কিংবা আহত হলে কোন কর্মী সুযোগ-সুবিধা পেতো না। এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। মালয়েশিয়ায় প্রায় ৮০ হাজার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা বৈধ শ্রমিকের অপেক্ষায় আছে। বাজার খুললেই এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের প্রধান কার্যালয়ে সোমবার (০৯ জানুয়ারি) সাক্ষাতকালে বেস্টিনেটের প্রতিষ্ঠাতা দাতো শ্রী মোহাম্মদ আমিন বিন আব্দুল নুর দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নতুন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগে শ্রমিকের নিরাপত্তা, বীমা, বেতন-ভাতাসহ সকল সুযোগ সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এখন কর্মীরা বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় এলে এসব সুযোগ-সুবিধা চাকরিতে যোগদানের দিন থেকেই পাবেন। বাংলাদেশের কর্মীরা এর আগে নানা ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়ায় এসেছে। এতে বিভিন্ন সময় শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে শ্রমিকরাও হয়েছে প্রতারিত। প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছে। দেশে ঘরবাড়ি হারিয়েছে। সুদে টাকা নিয়ে ঋণের জালে জড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় এভাবেই চলছিল বাজারটি। কিন্তু, এই অবস্থা পরিবর্তন করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে কর্মী নিয়োগ করার একটি পথ খুঁজতে থাকে সরকার। নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হঠাতে ই-টেন্ডারিংয়ের মতোই অনলাইনে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যা এখন বাস্তবে রূপ নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

গত রবিবার মালয়েশিয়ার পুত্রাজায়ায় অবস্থিত সিনারফ্ল্যাক্স-এর কার্যালয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ ইয়াহিয়া বলেন, বাংলাদেশিসহ বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়ে তারা প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন। যেকোনো সময় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের অনুমোদন পেলেই, তারা কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক আধুনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের দ্বার যেকোনো সময় খুলছে। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা পেলেই কর্মী নিয়োগ শুরু হবে। এবার নতুন পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগে প্রতারণা বন্ধ হবে। চাকরির নিরাপত্তা থাকবে।

‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসা শুরু হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম বলেন, আমরা আমাদের দিক থেকে একদম প্রস্তুত আছি। মালয়েশিয়া সরকার যখন চাইবে কর্মী আসা শুরু হবে।

তিনি বলেন, যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি ক্লিন ইমেজের, যাদের ট্রাক রেকর্ড ভাল তারাই ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবে।

উল্লেখ্য, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ রেখে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী এগ্রিকালচার, ম্যানুফ্যাকচারিং, কনস্ট্রাকশনসহ ৫টি খাতে বিপুলসংখ্যক কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া। তবে চুক্তির পরদিনই মালয়েশিয়া সরকার বিদেশি কর্মী নিয়োগ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়। ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির আলোকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো দিন বাজারটি উন্মুক্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/জেডটি/এনআই/জানুয়ারি ০৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর