thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

দালালচক্রের দৌরাত্ম্য মালয়েশিয়াতেও

২০১৭ জানুয়ারি ১৪ ২১:০৯:২৯
দালালচক্রের দৌরাত্ম্য মালয়েশিয়াতেও

মালয়েশিয়ার কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় থাকেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ইব্রাহিম মানিক। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষে বর্তমানে তিনি অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছেন। মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। ইব্রাহিম মানিক বৈধতা নিতে ভিসার জন্য পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে যোগাযোগ করেন টাঙ্গাইলের মাসুদের সঙ্গে। মাসুদও মালয়েশিয়ায় একই এলাকায় থাকেন দীর্ঘদিন ধরে।

দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইব্রাহিম মানিক জানান, ভিসা করে দেওয়ার জন্য মাসুদ দুই দফায় ১০ হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মূদ্রায় প্রায় দুই লাখ টাকা) তার কাছ থেকে নিয়েছেন। প্রথমবার মাসুদ ২০১৫ সালে অক্টোবর মাসে ৫ হাজার রিঙ্গিত নেয় এবং ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় আরও ৫ হাজার রিঙ্গিত নেন তিনি।

ইব্রাহিম মানিকের অভিযোগ এতোগুলো টাকা নিয়েও মাসুদ তাকে ভিসা করে দেয়নি। প্রথম দফায় পাসপোর্টে একটি ভিসা লাগিয়ে দেয়। অনলাইনে চেক করতে গেলে তা ভুয়া বলে জানা যায়। পরেরবার মানিকের ছবির পরিবর্তে তার পাসপোর্টে অন্যের ছবিযুক্ত ভুয়া ভিসা লাগিয়ে দেয়। এর কৈফিয়ত এবং টাকা চাইতে গেলে উল্টো মানিককে জীবননাশের হুমকি দেন মাসুদ।

মানিক বলেন, বর্তমানে তিনি একটি গ্লাস কোম্পানিতে কাজ করেন। অবৈধ হওয়ায় সচরাচর বাইরে বের হতে পারেন না। কাজ শেষে রুমেই বেশি থাকেন।

সরেজমিনে কেলাংয়ের কাপার বাতু লিমার মিনহু ফ্যাক্টরি এলাকায় প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাসুদ একসময় কর্মী হিসেবে মালয়েশিয়ায় গেলেও বর্তমানে তিনি আর কোনো জায়গায় কাজ করেন না। ইব্রাহিম মানিকের মতো অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের কাছ থেকেই ভিসা করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন মাসুদ। ওই এলাকায় ইন্ডিয়ানদের সমন্বয়ে তার একটি গ্যাং স্টার রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েজন প্রবাসী বাংলাদেশি। প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করাই ওই গ্যাং স্টার গ্রুপের কাজ। এছাড়া সেখানে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসাও রয়েছে তাদের। প্রবাসী কর্মীরা এদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হলেও ভয়ে মুখ খোলেন না।

গত এক সপ্তাহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে জানা গেছে, দেশটিতে কর্মরত বৈধ-অবৈধ মিলে ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি রয়েছেন। এসব বাংলাদেশিকে ঘিরে সেখানেও মাসুদের মতো প্রায় ১০ হাজারের দালালের থাবা রয়েছে। গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি দালাল চক্র। বৈধ হওয়া ও মালিকের কাছে কাজ পাওয়া, সব জায়গাতেই দালালকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের। দ্বিতীয় দফায় মালয়েশিয়ায় কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ ঘোষণার কথা শুনেই এসব দালালচক্র কর্মীদের বৈধ করে দেওয়ার নামে ৫ থেকে ১০ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি নিচ্ছে। যদিও বৈধ হতে ১২ শ’ রিঙ্গিত জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়।

কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দেন দরবার করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ান সরকার এক বছরের জন্য কর্মীদের সময় বেধে দিয়েছিল। সেই সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পার হয়েছে। তবে মালয়েশিয়ান সরকার ফের আরও ৬ মাস সময় দেবেন বলে মনে করছি।

গত কয়েকদিন মালয়েশিয়ায় ঘুরে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি দালালের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা রীতিমতো নিজেদের নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে প্রকাশ্যে দালালি ব্যবসা করছেন। তারা বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের বৈধ করে দেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীদের বৈধ করতে পারেননি। কর্মীদের টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না তারা। উল্টো কর্মীদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে দালালের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় অবৈধ কর্মীদের ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হচ্ছে। একদিকে মালিক তাদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে দালালদের প্রতিমাসে টাকা দিতে হচ্ছে থানায় টাকা দেওয়ার নামে। আবার বৈধতার নামে টাকা নিচ্ছে। ফলে হার ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পড়ে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি দালাল দেশটিতে কর্মী কিনছে আর বিক্রি করছে। তারা যে যেভাবে পারে সেভাবেই কর্মীদের শোষণ করছে। কখন হাইকমিশনের নামে, কখন পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে দেওয়ার নামে আবার কখন বৈধ করে দেওয়ার নামে। কর্মীরা কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। কর্মীরা বাধ্য হচ্ছে দালালদের কথা মতো চলতে। বৈধ হওয়ার আবেদন করতে কোনো কর্মীকে ১২ শ’ রিঙ্গিত জমা দেওয়া লাগলেও আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারছি অনেকেই দালালদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য নিশ্চিত মনে বসে আছে। এই দালালরা আর কেউ নন, তারা বাংলাদেশেরই মানুষ। তারাও একদিন কর্মী হিসাবেই মালয়েশিয়ায় এসেছেন। দীর্ঘদিন দেশটিতে বসবাস করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি তাদের পুলিশের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

জানা গেছে, দ্বিতীয় বারের মতো মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য সুযোগ দিবে। তবে, এ ঘোষণার আগেই দেশটিতে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চলছে প্রতিদিন। গত ১২ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) রাতে বুকিত বিনতাং এলাকায় স্থানীয় সময় রাত দশটার দিকে অভিযান শুরু হয়। বেশ কিছু কর্মী রসনাবিলাস নামে বাঙালি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে অনেককে খাবার ফেলে নিরাপদে চলে যেতে দেখা যায়।

দু’ একজন বৈধ কর্মী পুলিশের অভিযান চলা কালেও বসে খাচ্ছিল। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। পুলিশ কর্মী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার কাউকে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ আগে ঘুষ খেত না। বাংলাদেশি দালালরাই তাদের ঘুষ খাওয়া শিখিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

এ বিষয়ে কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে জানান, আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দিতে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার বৈধ করার সুযোগ দিলেও কর্মীদেরই বৈধ হওয়ার আগ্রহ কম দেখা যায়। তারা হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে চায় না। এর একটা কারণ হচ্ছে হাইকমিশন পর্যন্ত আসতে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে এমন ভয় থেকে, অন্য একটা কারণ হচ্ছে দালালরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বৈধ করার। সব দায়িত্ব তারা দালালদের হাতেই ছেড়ে দেন। পরে যখন সময় শেষ হওয়ার পথে তখন দেখেন দালালরা তাদের বৈধ করতে পারেনি। কাজটা নিজের। এখানে কোন দালাল দিয়ে নিজের কাজ করা যাবে না। কর্মীরা আসবে। তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে আবেদন করবে। তারপরই কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে বৈধ হবে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এপি/জানুয়ারি ১৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর