thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

‘দৃষ্টান্ত হয়ে রইল নারায়ণগঞ্জের রায়’

২০১৭ জানুয়ারি ১৬ ২২:৫১:১০
‘দৃষ্টান্ত হয়ে রইল নারায়ণগঞ্জের রায়’

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল গোটা জাতিকে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সরব হয়েছিল সমগ্র জাতি। সোমবার (১৬ জানুয়ারি) সেই মামলা রায়ে নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত ৩৫ আসামির ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বাকিরাও পেয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড। এই রায়কে দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা দৃষ্টান্তমূলক বলে অভিহিত করেছেন।

রায় ঘোষণার পর সোমবার গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় আইন বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত দেন।

সাত খুনের এ ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলার বিচারকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। বিচার শুরুর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই মামলার রায় ঘোষণা করলেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন।

রায়ের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আসামিদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের সদস্য ছিলেন। এরপরও সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় উদ্বেগের অবসান হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রায়ের পর সমস্ত জাতি আজকে স্বস্তি পাচ্ছে। আমি মনে করি, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় হয়েছে। এ রায়ে প্রমাণিত হলো যে দেশে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। যতোই শক্তিশালী হোক, যেই বাহিনীরই লোক হোক না কেন, অপরাধ করলে তার বিচার হওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে বিচার হয়েছে।’

এখন উচ্চ আদালতেও এই শাস্তি বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে জানান মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টে এই মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে আসবে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব অপরাধ যারা করেছে, তাদের শাস্তি যাতে বহাল থাকে।’

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলা ছাড়া এক মামলায় একসঙ্গে ২৬ জনকে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনাও নিকট অতীতে নেই বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের তিন শতাধিক সদস্যকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়।

একসঙ্গে এতো আসামির সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘একটি মামলায় এতোজনকে ফাঁসি দেওয়ার নজির খুব কম আছে। তার সঙ্গে আবার ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই মামলায় একদিকে র‌্যাব, অপরদিকে তাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারাও খুব প্রভাবশালী এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাদের লোকজন ছিল। তারপরও বিচারক সবরকম প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচার করেছেন। সেক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের রায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

নিম্ন আদালতের মতো এই মামলার আপিল উচ্চ আদালতেও দ্রুততার সঙ্গে নিস্পন্ন হবে বলে আশা করছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন মামলা অবশ্যই উচ্চ আদালতে আসবে। আমরা আশা করব উচ্চ আদালত সাক্ষ্য যাচাই এবং সবরকম ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে নেবে। যত ত্বরিত গতিতে উচ্চ আদালতের বিচারকার্য সমাধান হয়, জনমনে ততোই স্বস্তি আসবে।’

তবে এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে অভিমত জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবীর। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এই মামলার বেশিরভাগ আসামিই ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে। যারা নাগরিকদের জানমাল রক্ষার দায়িত্বে থাকেন তারাই যদি এভাবে নির্বিচারে প্রাণ হরণ করেন, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক, উদ্বেগজনক। এলিট ফোর্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রথম দিকে র‌্যাবের বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। কিছু সদস্যের জন্য এসব ঘটনায় তাদের সেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

বর্তমান সরকারের সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও এ বিচারকে অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো, অপরাধী যতো শক্তিশালীই হোক, যে সংস্থাতেই কাজ করুক, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ালে আইন অনুযায়ী বিচার হয়। আমার মনে হয় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট হয়েছে। এখন অন্যান্য যারা অপরাধ করছে তারা কিন্তু সতর্ক হয়ে যাবে। সেদিক দিয়ে এটা সবার জন্য দৃষ্টান্ত।’

দ্রুততার সঙ্গে এতো বড় একটি মামলা শেষ করায় নিম্ন আদালতের বিচারক ও আইনজীবীদের কৃতিত্বও দেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

তবে মামলার প্রধান আসামি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের আইনজীবী এফআরএম লুৎফুর রহমান মনে করেন, তারা ন্যায়বিচার পাননি। এজন্য উচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন বলেও আশা তার।

তিনি বলেন, ‘আমি আসামিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি, তারপরও আদালত সর্বোচ্চ দণ্ড দিয়েছেন। আমরা এখানে ন্যায়বিচার পাইনি। তাই এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’

এই মামলায় সর্বমোট আসামি ৩৫ জন। তার মধ্যে কারাগারে থাকা ২৩ জন রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত আসামিদের ১৭ জনই র‍্যাবের সাবেক সদস্য।

মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ২৬ আসামি : র‍্যাব-১১-এর সাবেক সদস্যরা হলেন চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম (পলাতক), সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সৈনিক আল আমিন (পলাতক), সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক), সার্জেন্ট এনামুল কবীর (পলাতক)। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকিরা হলেন-নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, তার সহযোগী মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান (চার্চিল), সেলিম (পলাতক), সানাউল্লাহ ছানা (পলাতক), ম্যানেজার শাহজাহান (পলাতক) ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন (পলাতক)।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে ৯ জনই পলাতক রয়েছেন।

বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া আসামি : র‍্যাব-১১-এর সাবেক সদস্য এএসআই আবুল কালাম আজাদ (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (পলাতক) (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), করপোরাল মোখলেছুর রহমান (পলাতক) (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), করপোরাল রুহুল আমিন (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর), কনস্টেবল বাবুল হাসান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর), কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (পলাতক) (অপহরণের দায়ে ১০ বছর, সাক্ষ্য-প্রমাণ সরানোর দায়ে ৭ বছর) ও সৈনিক নুরুজ্জামান (অপহরণের দায়ে ১০ বছর)।

ঘটনা, মামলা ও বিচার :

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

ঘটনার তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। ঘটনার এক দিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা করেন নিহত চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

পরে দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ। ১১ মাস তদন্তের পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল র‍্যাবের সাবেক ২৫ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার অভিযোগ গঠন হয়। প্রায় সাত মাসে ৩৮ কর্মদিবস মামলার বিচারকাজ চলে। বিচার শেষে গত ৩০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১৬ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেন। সেই অনুযায়ী সোমবার এই রায় ঘোষণা করা হয়।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/এনআই/জানুয়ারি ১৬, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর