thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল 24, ৯ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৪ শাওয়াল 1445

২৯ বছরেও বিচার শেষ হয়নি চট্টগ্রাম গণহত্যার

২০১৭ জানুয়ারি ২৪ ১১:১৫:৪৭
২৯ বছরেও বিচার শেষ হয়নি চট্টগ্রাম গণহত্যার

সাইফুল ইসলাম শিল্পী, চট্টগ্রাম : আজ ২৪ জানুয়ারি। রক্তস্নাত চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস। ১৯৮৮ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর লালদীঘি ময়দানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করে। আহত হয় শত শত মানুষ। সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।

জানা যায়, শেখ হাসিনার উপর গুলি করার সময় এক পুলিশ রাইফেলের কানেকশন বেল্ট খুলে ফেলায় তিনি বেঁচে যান। এ সময় আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে আইনজীবী সমিতি অফিসে নিয়ে রক্ষা করেন।

এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ২৪ জানুয়ারিকে ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। গণহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরণে নগরীর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাদদেশে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিফলক। স্থাপিত স্মৃতিফলকটির অবস্থা এখন শোচনীয়। অযত্ন অবহেলায় পড়ে রয়েছে এটি। বছরের একটি দিন শহীদদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালেও বাকি সময় আর কেউ খবর রাখে না তাদের। প্রতিবছর গণহত্যা দিবসে স্মৃতিস্তটির উন্নয়নের জন্য এবং একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করার দাবি জানানো হলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ২৯ বছর পূর্ণ হলেও এখনও বিচার পাননি নিহতদের স্বজনরা। আদালতে ঝুলে আছে মামলার বিচার কাজ। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে আদালত ভবনের প্রধান গেটে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে প্রতি বছর এ দিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।

ওই ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালি জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি কাদের খান আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করার পর ২০০০ সালের মে মাসে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন (চার্জ ফ্রেম) করা হয়। ১৬৮ জনের মধ্যে ৪১ জন সাক্ষী ইতোমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর ৭ বছর যাবত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় বা রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের হাজির করতে না পারায় মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এরই মধ্যে মারা গেছেন মামলার বাদী শহীদুল হুদাও।

মামলায় সাক্ষীদের হাজির না করা প্রসঙ্গে এই আদালতের সাবেক বিচারক গোলাম সরওয়ার এক আদেশে বলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশের।

২৪ জানুয়ারি গণহত্যার প্রত্যক্ষ্যদর্শী নগর আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল জানান, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে এমন একটি আলোচিত মামলা ঝুলে থাকা কোনমতেই কাম্য নয়। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ গণহত্যার বিচার না হওয়া মনে কষ্ট রয়ে গেছে।

গণহত্যায় নিহত স্বপন চৌধুরীর নিকটাত্মীয় আইনজীবী শিবুচন্দ্র মজুমদার বলেন, কেবল ২৪ জানুয়ারি এলে সবাই গণহত্যার শহীদ পরিবারের খোঁজ করেন। নতুবা সারাবছর কেউ খবরও নেয় না। কি রকম নিগৃহীত জীবনযাপন করছে ওরা তা বলাবাহুল্য। আমরা চাই সরকার আসামিদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসুক।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে জনসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে তৎকালীন ১৫ দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর ও জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলিতে সেদিন শেখ হাসিনা ও কেন্দ্রীয় নেতারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান ২৪ জন ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। আহত হন আরও প্রায় তিন শতাধিক। নৃশংসতার এক পর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহত অধিকাংশদের রাতের অন্ধকারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নগরীর অভয় মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে চলে লাশ গুম করার চেষ্টা।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডির চার্জশিটভুক্ত ৮ আসামি হলেন-সাবেক সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতয়ালি থানার সাবেক টহল পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল, ৬ কনস্টেবল প্রদীপ বড়ুয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন, শাহ আবদুল্লাহ, আবদুস সালাম এবং বশির উদ্দিন। এদের মধ্যে গোবিন্দ চন্দ্র ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। আর প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ এবং মির্জা রকিবুল হুদা ২০০৩ সাল থেকে জামিনে রয়েছেন বলে জানা যায়।

অন্যদিকে বশির উদ্দিন ও আবদুস সালাম জামিনে থাকা অবস্থায় মারা যান। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা এবং সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আবদুল কাদেরও মারা গেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে জানান, সাক্ষীরা হাজির না হওয়া, পুলিশের গাফিলতি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদাসীনতায় কারণে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা যাচ্ছে না।

তবে আগামী ৩১ জানুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সেদিনের গণহত্যায় নিহতের আত্মীয়স্বজন ও সাংবাদিকসহ মোট ৯ জনকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরীসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র মতে ১৬৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৪১ জন এ পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন, সেদিনের ঘটনায় নিহত অজিত সরকারের স্ত্রী শেফালী সরকার, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন সাক্ষ্য দিয়েছেন।

গণহত্যায় নিহত সেই ২৪ জন হলেন-মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকুন্ড থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক ডি কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ এবং শাহাদাত।

(দ্য রিপোর্ট/একেএ/এমকে/এনআই/জানুয়ারি ২৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর