thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

হিসাব মান লঙ্ঘন করেই শেয়ারবাজারে আসতে চায় ইনডেক্স অ্যাগ্রো

২০১৭ জানুয়ারি ২৪ ২৩:০৬:২২
হিসাব মান লঙ্ঘন করেই শেয়ারবাজারে আসতে চায় ইনডেক্স অ্যাগ্রো

আর্থিক হিসাবে আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ হিসাব মান (আইএএস ও বিএএস) লঙ্ঘন করে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইনডেক্স অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত বছর ১৮ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি ট্রাস্ট মিলনায়তনে রোড শো করেছে।

প্রতিষ্ঠানটিতে কোম্পানি আইন ব্যত্যয়সহ নানা অনিয়ম ঘটেছে। কোম্পানির রেড হেরিং প্রসপেক্টাস (খসড়া পত্র) পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শেয়ার ইস্যু নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়ে পৃষ্ঠাভেদে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেয়া হয়েছে।

রেড হেরিং প্রসপেক্টাসের ৭ ও ৪০ পৃষ্ঠা অনুযায়ী ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ইনডেক্স অ্যাগ্রোর কোনো শেয়ার বিক্রি করা হয়নি। তবে সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইনডেক্স হোল্ডিংস ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট ধারণকৃত শেয়ারের ৬৫ লাখ নগদে বিক্রি করে। কিন্তু ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে বলে ১৬৬ পৃষ্ঠায় ভুলভাবে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

বিএএস-১৬ অনুযায়ী, ভূমি উন্নয়ন অবচয়যোগ্য সম্পদ। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ভূমি উন্নয়নের ওপর অবচয় চার্জ করে না। যাতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে।

১৮২ পৃষ্ঠা অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত অবচয় হিসাবে স্বল্পমেয়াদী পার্থক্য না হওয়ায় ডেফার্ড ট্যাক্স (বিলম্বিত কর) করা হয়নি। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও ডেফার্ড ট্যাক্স গণনা না করে বিএএস-১২ লঙ্ঘন করেছে।


বিএএস-৩৬ অনুযায়ী, অবচয়যোগ্য সম্পদের বর্তমান মূল্য যদি ভবিষ্যতে সুবিধা আনার তুলনায় কম হয় তাহলে ইমপেয়ারমেন্ট করতে হয়। এতে ব্যয় বাড়ে ও সম্পদ কমে আসে। যা হওয়াটা স্বাভাবিক বলে মনে করেন হিসাববিদরা। কিন্তু ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ইমপেয়ারমেন্ট টেস্ট না করিয়ে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে।

বিএসইসি’র সাবেক অফিস অব দ্য চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কনসালট্যান্ট মো. মনোয়ার হোসেন (এফসিএমএ, সিপিএ, এফসিএ, এসিএ) বলেন, অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অবশ্যই ভূমি উন্নয়নের ওপর অবচয় চার্জ করতে হবে। অন্যথায় মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখানো হবে। যা বিনিয়োগকারীদের মাঝে ভুল তথ্য প্রদান করা হবে।

ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের সাবেক হেড অব ইন্টারনাল অডিট সামসুর রহমান (এফসিএমএ) বলেন, প্রাচীর, ফ্যাক্টরির ভিতরে রাস্তা, পার্কিং প্লেস, বাগান ইত্যাদি ভূমি উন্নয়ন সম্পদ। এসব সম্পদ কখনো ভবন বা সিভিল কনস্ট্রাকশনের সাথে যুক্ত হতে পারে না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) করপোরেট গভর্নেন্স ফাইন্যান্সিয়াল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে ইমপেয়ারমেন্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো গতানুগতিকভাবে তা না করে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে থাকে।


কোম্পানিটি রিডিউসিং পদ্ধতিতে (ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে) অবচয় চার্জ করলেও রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাসের (পুনর্মূল্যায়নজনিত উদ্বৃত্ত) ওপর ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত স্ট্রেইট লাইন (সরল রৈখিক) পদ্ধতিতে অবচয় ধার্য (ডেফ্রিশিয়েশন) করেছে। তবে অন্যসব স্থায়ী সম্পদের ক্ষেত্রে রিডিউসিং পদ্ধতিতেই হিসাব করা হয়।


১৭৩ পৃষ্ঠায় শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২১.০৭ টাকা ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৫.৩৩ টাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু একই বিষয় নিয়ে নোট-২৯-এ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০.৯১ টাকা ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৫.১৮ টাকা দেখানো হয়েছে।

নোট-২৯’য়ে এনএভিপিএস গণনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চলতি দায় (কারেন্ট লায়াবিলিটিস) হিসেবে ৮৯ কোটি ৪ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু ১৭৩ পৃষ্ঠায় ব্যালেন্স শিটে ৮৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।

নোট-২৯’য়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট সম্পদ হিসাবে ২১৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ও চলতি দায় হিসাবে ১০৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু ব্যালেন্স শিটে একই বিষয়ে যথাক্রমে ২১৪ কোটি ৮৬ লাখ ও ১০৩ কোটি ১০ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।


২২২ পৃষ্ঠায় নোট-১৪’তে রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাস থেকে ভুলভাবে ইমপেয়ারমেন্ট বলে ২৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৯ টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে।

২৬৪ পৃষ্ঠায় নোট-১৩’তে রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাসে ওপেনিং ব্যালেন্স ৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সাথে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিভ্যালুয়েশনজনিত সারপ্লাস যোগ করা হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও যোগ বলে আবার বিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই বছর সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন(রিভ্যালুয়েশন)করা হয়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছরেও একইরকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১১ সালের ১৫ জুন সম্পদ রিভ্যালুয়েশনে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছে। কিন্তু এই অর্থবছরের শেষে রিভ্যালুয়েশন করা সত্ত্বেও পূর্ণ অবচয় চার্জ করা হয়েছে। ফলে বিএএস-১৬ লঙ্ঘন হয়েছে।

১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ইনডেক্স অ্যাগ্রোতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাহিন বিন মাজহার। একই সঙ্গে তিনি এক্স সিরামিকস, মোনালিসা সিরামিকস, ইনডেক্স পোল্ট্রি ও ইনডেক্স হোল্ডিংস এ এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যা কোম্পানি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

করপোরেট গভর্নেন্স গাইডলাইনস পরিপালন নিয়ে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। এ বিষয়ে ইনডেক্স অ্যাগ্রো সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছে বলে উল্লেখ করলেও প্রসপেক্টাসে পাওয়া যায়নি।

৬৭ ও ৬৮ পৃষ্ঠা অনুযায়ী, প্রতিবছর রিভ্যালুয়েশন সারপ্লাসের ওপর চার্জকৃত অবচয় রিভ্যালুয়েশন রিজার্ভ থেকে বাদ দিয়ে রিটেইন আর্নিংসে যোগ করা হয়েছে। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবছরে করা হয়নি। একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে হিসাব মান লঙ্ঘন হয়েছে।

শেয়ারবাজারে আসার আগে অন্য সব কোম্পানির ন্যায় ইনডেক্স অ্যাগ্রোতেও অস্বাভাবিক মুনাফা লক্ষ্য করা গেছে। কোম্পানি ১ লাখ টাকা দিয়ে ৮ বছরে (২০০৪-২০১২) ৪২ কোটি ৬০ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। অর্থাৎ কোম্পানি ১ লাখ টাকা দিয়ে এই ৮ বছরে গড়ে ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে।

কোম্পানি প্রতিটি শেয়ারে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা পেতে পারে। আর্নিং বেজড অনুযায়ী কোম্পানির এ দর হয়। বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, বিগত ৫ বছরের ওয়েটেড ইপিএসের সাথে পিই হিসেবে ১০ গুণ করতে হয়। এর সঙ্গে এনএভিপিএস যোগ করতে হয়। পরে তা ২ দিয়ে ভাগ করতে হয়। এ হিসেবে ইনডেক্স এগ্রোর দর আসে ৩১.৯২ টাকা।

এ সব বিষয়ে জানতে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু নজরুল ইসলাম তার কোম্পানির আইএএস ও বিএএস লঙ্ঘন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

(দ্য রিপোর্ট/আরএ/জেডটি/এনআই/জানুয়ারি ২৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর