thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ ঘায়েলে আ’লীগ

নেতা-কর্মীর পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ০৪ ২২:১২:১৫
নেতা-কর্মীর পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ

ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি স্বার্থে দলকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়তই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। কিছুতেই থামছে না ক্ষমতাসীন দলটির মাঠপর্যায়ে সহিংসতা ও সংঘর্ষ। এর ফলে শুধু দলীয় লোকই নয়, সাধারণ মানুষসহ সাংবাদিককেও প্রাণ হারাতে হচ্ছে।

এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে বলেও জানিয়েছে দলটির শীর্ষ নেতারা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, শুধু নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হানাহানিতে গত ৮ বছরে আওয়ামী লীগের তিন শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।

গত কয়েক বছরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ দলগুলোর নেতাকর্মীরা। দলীয় পদ-পদবির আশায় কখনও বা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। আবার কখনও ঠিকাদার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্যে হাসিল করছেন সুবিধাবাদিরা। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সংঘর্ষে জড়িয়ে যাচ্ছেন তারা। দলীয়ভাবে অবশ্যই এদের প্রতি নিবিড়ভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে। এদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে আমাদের কঠোর নির্দেশনা আছে, যেসব জায়গায় রাজনৈতিক সহিংসতা হচ্ছে, আগামীতে যাতে এ ধরনের সহিংসতা না ঘটে সেই জন্যে সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেখানে হচ্ছে সেখানে দলীয়ভাবে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, কাউকে ছাড় দিচ্ছি না।’

সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল নিহতের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। দলের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিসকেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই ৮৩ জন। আর ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণহানি হয়েছে ১৫৩ জনের। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মধ্যে সংঘাতে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। আগের বছর ২০১৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৪৭। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৪ জন।

নতুন বছরে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য লিটন হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এ হত্যাকাণ্ডের পর সংসদ সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাসুদকে আটক করা হয়। এ হত্যার রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি।

এই রেশ কাটতে না কাটতেই গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিতে আহত হন সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। পরদিন শুক্রবার তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর খবর শুনে তার নানি রোকেয়া বেগমও মারা যান।

ওই রাতেই পাবনার ঈশ্বরদীতে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ দুজন কর্মী গুলিবিদ্ধ এবং আরও দুজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। ওই রাতেই দলীয় প্রতিপক্ষ শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান মডেল কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম হাসান খানকে (৫২) কুপিয়ে আহত করে।

এর আগে বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে খুন হন নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রভাষ রায়। তার স্ত্রী টুটুল রানীর অভিযোগ, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের জের ধরে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ওই নির্বাচনের পরদিন প্রভাষ রায়ের বাড়িতে হামলা করেছিল প্রতিপক্ষরা।

এর আগে ১০ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হন। এ ঘটনায় অন্তত ২০ জন আহত হন।

এর আগে একইদিনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ সিকদার এবং সাবেক চেয়ারম্যান শফিউদ্দিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হোসেন খাঁ নিহত হন। বরগুনা জেলায়ও চলছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রেসারেসি। এর জের ধরে বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাসানুর রহমানের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে রাজধানীতে ১১ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে পাথরঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক বিলকিস আরা রানী।

১২ জানুয়ারি রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে সিট ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

৩ জানুয়ারি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমানের বাসভবনে হামলা চালায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর আগের দিন কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবার টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত হন এক প্রবীণ শিক্ষক। নতুন বছরের শুরুতেই গণমাধ্যমের শিরোনামে আসে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এক পথচারী নারী নিহত হন। এ ঘটনায় জেড এ মাহমুদ অভিযোগ করেন, মাদক ব্যবসার বিরোধিতা করায় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়া এলাকায় গত ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন অন্তঃস্বত্ত্বা নাজমা।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে ছোটখাট কোন্দল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে সীমা লঙ্ঘনকারীদের অপরাধের দায় আওয়ামী লীগ নেবে না।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগে নেতার গুলিতে সাংবাদিক নিহতের ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শাহজাদপুরে সাংবাদিক শিমুল হত্যার ঘটনায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এ ঘটনায় জড়িতরা যতই প্রভাবশালী হোক, যে দলেরই হোক না কেনো তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

শিমুল হত্যার ঘটনা প্রসঙ্গে শুক্রবার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না, সে আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোক। এ ধরনের জঘন্য কাজ যারা করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এরা নিজেরা যেমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে একইভাবে দলকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে। আগেও আমরা এ ধরনের ঘটনায় ছাড় দেইনি, এখনও দেওয়া হবে না।

(দ্য রিপোর্ট/এমএইচ/এস/এপি/ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর