thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

 

ভাষার ইশারা

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২১ ০০:০৬:৫২
ভাষার ইশারা

ড. পাবলো শাহি

একুশ শতকের এই মানবিক জীবননীতিতে ভাষার দাবী অন্যান্য গণতান্ত্রিক দাবীগুলোর মধ্যে প্রধানতম। মানুষ নিজের অস্তিত্বের লক্ষণ ও আগ্রহ দিয়ে ভাষাকে বিনির্মাণ করে। বিশেষতঃ যে জাতি জাগরণের মুখে ভাষার মত বিস্তৃত চারণ ও কর্ষণ ক্ষেত্র দ্বার তাড়িত ও উজ্জ্বীবিত- সেই জাতির চৈতন্য তত ধারালো, তত জীবন সমীক্ষণের ধারণার মধ্যে প্রোথিত।

ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়; বা এর থেকে সে পরিবর্তন সাধারণ মনে হলেও তার মধ্যে লুক্কায়িত থাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের কোডগুলি, ইশারাগুলি। এই জাতীয় বিকাশের ধাপগুলি নানা স্তর ভেদে বিকশিত হলেও তার একটা পরিণতি ভাষাকে ছুঁয়ে যায়। ফলতঃ ভাষা সেই জাতীয় সংস্কৃতির নবোন্মোচনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে কিংবা বলা যায় ভাষামন্ত্রে, পুরাণে, রূপকে বা প্রতীক ভাবনার আশ্রয়ে- সে ইতিহাস লুক্কায়িত রাখে। সেখানে খননকার্য চালালে জৈব, প্রাকৃত, ধর্মীয় এবং জাতীয় অনুভবগুলি আমাদের চোখের সম্মুখে আলগা হয়ে পড়ে।

যদু বা জালালউদ্দীনের মত একাত্তরের আগে বাঙালীর শাসক হাতে গুনা কয়েকজন কেবল বাঙালী ছিলেন। কিন্তু চর্যাপদের মানুষ বৌদ্ধগণ ও দোহাকারগণ যাঁরা আগে থেকেই ছিলেন বাংলা ভাষার আদিমতম কবি। হাজার বছরের এই বাঙালীর প্রবণতা ও জীবন দখলের কৃৎকৌশল যা চর্যাপদ হয়ে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে, খনার বচন হয়ে প্রথম স্তর আর দোভাষী পুঁথিসাহিত্য ও রোমান্টিক প্রণয় উপখ্যান হয়ে অতিক্রম করলো দ্বিতীয় স্তর। এভাবে মুসলমানদের হাতে হল এ ভাষার নবজন্ম।

যেমন মীননাথ, লুইপা, কা‎হ্নুপা-এঁরা ছিলেন সূতিকাগৃহের কবি; তেমনি চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কাশীরাম দাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, আলাউল, দৌলত কাজী, শাহ মুহাম্মদ সগীর প্রমুখ ছিল মুসলমান বিদ্যোৎসাহিতার অবশ্যম্ভাবী ফসল। আর তৃতীয় স্তর বাংলাসাহিত্য অতিক্রম করে ইংরেজ আমলে-- মাইকেল, রঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ সেই ইঙ্গবাংলা সাহিত্যের স্থপতি। এইভাবে বাঙালী তার ভাষা বর্ণে, র-এর ফুটকিতে তার জীবন ও জীবনদখলের প্রাকৃতিক দিক ও পণ্য নিয়ন্ত্রিত দিকটি বুঝে নিতে চেয়েছে। ৫২-তে জীবন ও জীবন শব্দটির পারিভাষিক অর্থ গ্রাস করতে চেয়েছে আর সেই শব্দ ৭১-এ এসে জীবনদখলের পণ্য নিয়ন্ত্রণ যা লাল সবুজ পতাকার মধ্যে চি‎হ্নিত হয়েছে।

তাই একুশ বাঙালী জীবনের; জীবনবোধের নান্দনিক রিফ্লেকশান- যার রক্তে, মাংসে মিশে আছে হাজার বছরের চৈতন্য। কবিতা-শিল্প-সাহিত্য যদি সেই স্বরূপের প্রাণ হয়; তাহলে দর্শন আর রাজনীতির মধ্যে যে চেতনারই অভিপ্রকাশ ঘটে।

নিজেকে মুক্ত রাখার প্রবণতা ও জীবনদখলের কৃৎকৌশল নাগালে আনার জন্য জবর দখলকারীদের দু’ভাগে মোকাবেলা করতে হয়। জবর দখলকারী চায় সংস্কৃতি আর পণ্য এ দু’টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এই দু’টি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক ও দর্শনগত অপকৌশল গ্রহণ করে। ফলতঃ বাঙালীকে তার সার্বিক আকাঙ্ক্ষার নাগাল তৈরী করতে প্রথম মাতৃভাষা নিয়ে যৌক্তিকতা এবং জীবনের উপর চাপিয়ে দেওয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে গান, কবিতা, প্রতিবাদ এবং রক্ত দিতে হয়েছে। একুশ সেই লিপ্ত ধারার প্রধান চৈতন্য, প্রধান প্রবক্তা। কিন্তু খ্রিষ্টীয় মনোগাঠনিক ভিত্তি ও মানসিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা আমাদের ক্লিশে মধ্যবিত্ত অর্থাৎ তথাকথিত ইউরোপীয় আধুনিকতা দিয়ে একুশের লক্ষণগুলি বোঝা যাবে না?

কেননা নজরুলের শাক্ত সম্প্রদায়ের মহাদেবী ‘কালী’কে, শক্তির উৎস হিসাবে কবিতায় গ্রহণ আমাদের সাহিত্যের আদী উৎসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কালী যেমন মা, সন্তান রক্ষাকারী তেমনি অসীম শক্তিদায়িনী; শত্রু মোকাবেলায় অভয় মূর্তি। তাই আমাদের শহীদ মিনারের ভেতর সেই মা (কাল+ঈ = কাল বা সময়ের সঙ্গে ঈ-প্রত্যয় যুক্ত হয়ে কাল বা সময়কে প্রকাশ করেছে) আল্লাহুর সাথে দোস্ত নবী মুহাম্মদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, বাউল ও সুফীদের আত্মমগ্ন চৈতন্যের বিকাশ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের আদিপত্য বিস্তার করেছে। এ-সব বিচ্ছিণœ রেখে অর্থাৎ আত্মবিচ্ছেদে বাঙালীকে চেনা যাবে না-- তথাকথিত ইউরোপীয় আধুনিকতায় অর্থাৎ কলোনি-চেতনায় তার স্বরূপ উন্মোচিত হয় না।

তাই শুধু ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্বীকৃতির মধ্যে একুশকে চেনা যাবে না; বরং সেটি শুধু স্তব রচনার ক্ষেত্রভূমি হতে পারে? কিন্তু সংস্কৃতি ও পণ্য বাজারের মধ্যে ছড়িয়ে থাকে সাম্রাজ্যের জবর দখলের ফাঁদ। তাই নান্দনিক ও ব্যবহারিক ভোগ্যসূচির পরিবর্তন ছাড়া জীবনের পরিবর্তনকে মাপা যায় না। ভাষার জন্য আত্মত্যাগ এটি মেন ফেনোমেনা তার থেকে আমাদের দ্যোতক, চি‎হ্ন, সংস্কার, বিশ্বাস, প্রতীক, রূপক ও ইশারগুলি বুঝে নেওয়া জরুরী আর তা ভাষাকে দিয়ে; সংস্কৃতিকে দিয়ে; ভোগ্যপণ্যকে দিয়ে বাঙালী-মোড়ক তৈরী করতে হবে। একুশতো আমাদের সেই কথা, সেই ডিসকোর্সে প্রবাহমাণ রাখে।

ফলতঃ অমর একুশে টেক্সট (পাঠ) তৈরী হয় চর্যাপদের শবর, ডোমনী থেকে। কেননা সেই তখন থেকেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে আমরা জিততে চেয়েছি। সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় সালাম, রফিকউদ্দীন, জব্বার ৫২-তে আমার সাধারণ জীবনে অসাধারণ বোধের চাবি তুলে ধরেছেন। যার মধ্য দিয়ে আমরা সাহিত্য ও ভোগ্যপণ্য দখলের আন্দোলনে যুগপৎ ভাষা খুঁজে পেয়েছি। কেননা, এই ভাষার নিজস্ব অর্থ ও ব্যঞ্জনা আছে; তার অর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল অর্থাৎ পণ্যের নিয়ন্ত্রণ আর ব্যঞ্জনা হচ্ছে সংস্কৃতি যা আমাদের চৈতন্যস্রোতকে নন্দনের ফুল পাতাতে ডালি ভড়িয়ে তোলে। আর তখনই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’, আমার মায়ের মুখের ভাষা বিশ্ব মায়ের বুকে’, ‘আগে জানি-না-রে দয়াল এমন হবে-রে’--এই বোধগুলি এক হয়ে ওঠে।

ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি একটি জাতিকে দখল করার জন্য প্রথম পদক্ষেপ সেই জাতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের পণ্যতালিকায় দখলদারিত্বের প্রভাব ফেলা। তাই সকল সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টা একই রকম যে--

এক. যাদের দখল করা হবে তাদেরকে নৃ-তাত্ত্বিকভাবে ছোট দেখানো।

দুই. ঐতিহাসিকভাবে তারা দখলকারীদের থেকে অনুন্নত সেটা বুঝানো।

বাঙালীর নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের স্ফূরণ এত স্পষ্ট যে তারে বোঝানো যায় নি তারা নৃ-তাত্ত্বিকভাবে খাটো কিংবা অনুন্নত। কার্যতঃ তারা নিজেদের মুক্ত ভাষা নির্মাণে সকল দুর্ভোগকে মেনে নেয়। আজকে তাই লালন শাহ্, কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ফিরে গিয়ে অমর একুশে চৈতন্যের স্বরূপ আমরা উন্মোচন করতে পারি। কেননা সংস্কৃতি মানে টোটাল ব্যাপার; সেখান ভাষা, জাতি, ধর্ম, ধর্মহীনতা, পরিবেশ, নারী, বৃদ্ধ ইত্যাদির জীবন ধারণের লড়াই-ই চি‎হ্নিত করে?

বুজুর্গ পাঠক, এইভাবে অধম যবন তৃণসম পাবলো শাহি আপনাদেরকে কহে-- অমর একুশে আমাদের সংস্কৃতির নাড়ীর তরুতে ক্রমশ চৈতন্যের ঘিলু ঢুকিয়ে দেয়। আর তথাকথিত আধুকিতাকে, ইঙ্গবাংলা এসটাবলিশমেন্টকে এভাবে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আর সেই প্রত্যাখ্যানের বড় ভাষা ‘২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২’ ও ‘২৬শে মার্চ, ১৯৭১’।

লেখক : কবি ও গবেষক

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর