thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

উৎসব ঘিরে পাখা মেলছে বাণিজ্য

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২১ ০১:১৫:০৩

‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী, কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ কথার সূত্র ধরে ‘বৃহৎ’ ও ‘মহৎ’ হওয়ার ইচ্ছায় কিনা কে জানে, আমাদের দেশে উৎসবে শামিল হওয়ার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। সর্বজনীন উৎসবগুলোর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এখন পয়লা বৈশাখ ‘বাংলা নববর্ষ’ এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তারপরই বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, ভ্যালেন্টাইনস ডে, বসন্ত উৎসব, ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের আলোয় ক্রমেই বড় করে জায়গা করে নিচ্ছে। উৎসব উদযাপনের এ স্বতঃস্ফূর্ততা নগর পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের মেঠো পথেও।

মানুষের উচ্ছ্বাসপূর্ণ অংশগ্রহণের কারণে এ উৎসব ঘিরে পাখা মেলছে নানামুখী বাণিজ্য। উৎসব উদযাপনের অনুষঙ্গের উপাদান যুগিয়ে কিংবা উৎসব মুখরতায় আরও মাতানোর আহ্বানে নতুন কোনো ধারণা নিয়ে হাজির হচ্ছে বাণিজ্য। এ বাণিজ্য উৎসব উদযাপনের প্রেরণার অনুষঙ্গ মনে করা হলেও কখনও কখনও যে তা নৈতিকতা উত্তীর্ণ নয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশিষ্টজনরা বলছেন, বাণিজ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবের প্রাণ ম্লান করে দিচ্ছে, নষ্ট করছে আন্তরিকতা।

বিশিষ্ট লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে এ বিষয়ে বলেন, বাণিজ্য রুচি, সংস্কৃতি, আবেগ এগুলোকে দেখে না। বাণিজ্য শুধু মুনাফা দেখে। মুনাফার জন্য যা দরকার তা করে। আমাদের সর্বজনীন উৎসবগুলোতে বাণিজ্য আক্রমণ করছে এটা মোটেই আনন্দের বিষয় নয়।

তিনি আরও বলেন, উৎসব উপলক্ষে মেলা হবে, কেনাবেচা হবে এটাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে উৎসবেরই প্রাধান্য থাকবে, বাণিজ্য নয়। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবকে ছাপিয়ে ওঠছে বাণিজ্য। উৎসব ঘিরে বাণিজ্য যে শুধু দেশি লোকরা করছে তা নয়, বিদেশিরাও করছে। স্পন্সরসহ নানা বাণিজ্যিক বিষয় জাড়ানোর কারণে উৎসবের মূল আবেদন নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে বাণিজ্য আমাদের উৎসবের প্রাণ দখল করে নিচ্ছে।

পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন আর নাগরিক মধ্যবিত্তের রীতি নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছেও পান্তা-ইলিশ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে ধরা দিচ্ছে। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও এটা নিয়ে এত মাতামাতি হত না। তাই এখন বৈশাখ ঘনিয়ে এলেই বাজারে ইলিশের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে অবৈধ ইলিশের মজুদ। জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় ইলিশের মাধ্যমে বাজার থেকে লুট হয় বিপুল অর্থ। উৎসবকে ঘিরে এ অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধে বিগত সময়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়েছে।

গত বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত টন ইলিশ মজুদের তথ্য পায় সরকার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ সব ইলিশ বাজারে বিক্রির নির্দেশনাও দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

কেউ কেউ নববর্ষে পান্তা খাওয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নেন না। তারা বলেন, পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের ঐতিহ্য নয়। কিছু মুনাফা লোভী সাময়িক ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে রমনাসহ বিভিন্ন স্থানে উচ্চমূল্যে এই পান্তা-ইলিশ বিক্রির ব্যবসা করে। কেউ কেউ বলছেন, সম্প্রতি বছরগুলোতে মিডিয়ায় পান্তা-ইলিশের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে হুজুগে বাঙালি এখন পান্তা-ইলিশকেই তাদের সংস্কৃতি মনে করছে।

ফেব্রুয়ারিকে উৎসবের মাস বলা যায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস তো ফুলের বন্ধনেই বাঁধা। এর একদিন আগে বসন্ত উৎসবে ফুলের অপরিহার্যতা কাউকে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে হয় না। আর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ফুল ছাড়া তো কল্পনাই করা যায় না। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আত্মদানকারী ভাইয়ের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে নিবেদিত হয় ফুল। তাই সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থা। যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে ফুলের।

ভালোবাসা দিবস ও শহীদ দিবসে শাহবাগসহ কমন ফুল বিক্রির স্থানগুলোর সঙ্গে পুরো রাজধানীর অলিগলি ভরে যায় ফুলের দোকানে। রাজপথেও চোখে পড়ে ভ্রাম্যমাণ ফুলের দোকান। কিছু দিন আগে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এবার পয়লা ফাল্গুন বসন্তের প্রথম দিন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সারাদেশে পাইকারি পর্যায়ে ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নেওয়া হয়। যা আগের বছর ছিল ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা। তবে খুচরা পর্যায়ে এ হার ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১০ হাজার ফুলের পাইকারি দোকান রয়েছে। খুচরা দোকান রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। উৎসবগুলোতে রাজধানীর ক্রেতাদের চড়ামূল্যে কিনতে হয় রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল।

বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব ও বিজয় দিবসে বাসন্তী শাড়িসহ পুরুষের বিভিন্ন ধরনের ফতুয়া, টি-শার্টের বাণিজ্যও কিন্তু কম জমে না। ফ্যাশন হাউসগুলো নানা আয়োজনে ক্রেতা ধরার প্রতিযোগিতায় নামে।

বিজয় দিবসে পতাকার ব্যবসা যে রমরমা তা চারিদিকে তাকালেই বোঝা যায়। ডিসেম্বর এলেই শহরের প্রতিটি বাড়িতে গর্ব ভরে উড়ে জাতীয় পতাকা। বাস-ট্রাকে তো আছেই, রিক্সার সামনেও যখন ছোট্ট লাল-সবুজ পতাকাটি উড়ে স্বাধীনতার অনুভবে শ্রমক্লান্ত চালক উদ্বেলিত হয় কিনা জানি না, অন্যরকম আনন্দে আমাদের বুকটা ভরে ওঠে।

নববর্ষ, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে মাথায় ও হাতে নানা শ্লোগান লেখা ব্র্যান্ড বেশ চোখে পড়ে এখন। শরীরে আল্পনা আঁকার বিষয়টিও এ উৎসবগুলোতে শহরে বেশ প্রচলিত হচ্ছে দিন দিন।

মোবাইল ও ইমেইল জায়গা করে নিলেও ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময়ে কার্ডের চাহিদা একেবারে হারিয়ে যায়নি। তবে এখানে বাণিজ্য হয়ত অশোভন মুনাফার পাখা মেলেনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

বিশেষ সংবাদ এর সর্বশেষ খবর

বিশেষ সংবাদ - এর সব খবর