thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা নেই সাগর-রুনির পরিবারের

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ১০ ২২:৩৯:৩২
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা নেই সাগর-রুনির পরিবারের

ফেব্রুয়ারি ১১ তারিখ, ২০১২ সালের এই তারিখটিতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী। সেই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে শনিবার। সেই সঙ্গে বাড়ছে এই সাংবাদিক দম্পতির পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিরাজ করা হতাশা-আক্ষেপের মাত্রা।

পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চললেও পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা স্পর্শকাতর এ হত্যাকাণ্ডের খুনি শনাক্ত করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কোনো অগ্রগতিও নেই। এ অবস্থায় সাগর-রুনীর পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়েছেন। অন্যদিকে, সাগর-রুনীর একমাত্র শিশুপুত্র মাহির সরওয়ার মেঘ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করলেও বেড়ে উঠছে বাবা-মায়ের আদরের শূন্যতা নিয়ে।

সাগর-রুনীর পরিবারের সদস্যরা দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোরকে জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আর কোনো আস্থা নেই তাদের। কোনো প্রত্যাশাও নেই। ওপরের চাপ থাকলে বিচার পাওয়া যায় না। তবে যত দিন বেঁচে থাকবেন, পরিবারের সদস্যদের হারানোর বিচার চেয়ে যাবেন তারা। সরকার আরও বেশি আন্তরিক হলে হয়তো এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হতো বলে অভিমত তাদের।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতের কোনো এক সময় পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ভাড়া বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক পদে চাকরিরত সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনী। এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রুনীর ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। চার দিন তদন্তের পর চাঞ্চল্যকর হিসেবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু দুই মাসে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হয় ডিবি। পরে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল উচ্চ আদালত মামলাটি র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনঃময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা হয় সাগর-রুনির লাশ। ভিসেরা আলামতসহ আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে র‌্যাবের ইনভেস্টিগেশন শাখা হত্যাকাণ্ডটি তদন্ত করছে। তারাও এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো সফলতার মুখ দেখেনি।

এ বিষয়ে মেহরুন রুনীর ভাই নওশের আলম রোমান দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের ক্লু ছিল না? ঘটনাস্থল থেকে অনেক ক্লু উদ্ধার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তবুও কোনো অগ্রগতি নেই। এটা অবশ্যই ব্যর্থতা। ৩টি সংস্থা তদন্তের কাজ করেছে। কিন্তু কেউই প্রকৃত খুনিদের শনাক্ত করতে পারছে না। অথচ এ ঘটনার পর জঙ্গিসহ অনেক হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হয়েছে। ৫ বছরেও এ মামলা নিয়ে যে গড়িমসি চলছে এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। তাদের যে কর্মকাণ্ড, তাতে আমাদের কোনো এক্সপেকটেশনও নেই। সরকার আরও বেশি আন্তরিক হলে হয়তো এ হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হতো। তবে আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছি, যত দিন বেঁচে আছি, বিচার চাইব।’

‘সাংবাদিক মহলের কাছে আপনাদের কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা’ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘বিচার পাওয়াটা হচ্ছে আসল ব্যাপার। আলাদা করে সাংবাদিকদের কাছে চাওয়ার কিছু নেই। তারা তাদের মতো করে সহকর্মীদের হত্যার বিচার চাইবে।’

৫ বছরেও মামলার উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি নেই, শুধুমাত্র চেষ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে-এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘মামলার তদন্ত র‌্যাব করলেও আলাদা কিছু মনে হয়নি। র‌্যাব এখনো দোষীদের চিহ্নিত করতে পারল না। র‌্যাবের তদন্তে আমরা হতাশ। আদৌ তদন্ত হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে আমাদের চরম সন্দেহ রয়েছে। হয় আসামিদের মধ্যে কোনো প্রভাবশালী জড়িত, যাকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে, না হয় মামলার তদন্তে যারা কাজ করেছেন তাদের দক্ষতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে।’

আদালতের নির্দেশে প্রতিমাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে আসছেন তদন্ত কর্মকর্তা ও র‌্যাব সদর দফতরের তদন্ত বিভাগের উপ-পরিচালক ও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মহিউদ্দিন আহমেদ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাজহারুল ইসলাম সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের এএসপি মহিউদ্দিনকে আগামী ২১ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৪৬টি ধার্য তারিখ অতিবাহিত হয়েছে।

এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মহিউদ্দিন আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে। বিভিন্ন পয়েন্টে আমাদের তদন্ত এগোচ্ছে। আমরা স্বাধীনভাবে তদন্ত করছি। এ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছি। সন্দেহভাজন ১৩০ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। আদালতের দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। আমরা আশাবাদী এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উৎঘাটন হবে।’

এ ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সময় শেষ হওয়ার আগেই তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে’। কিন্তু সেই ‘৪৮ ঘণ্টার অপেক্ষা’ শেষ হয়নি পাঁচ বছরেও।

আদালতের নির্দেশে র‌্যাবের কাছে তদন্ত হস্তান্তরের পর ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ এই পাঁচজনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই বছর আগস্টে গ্রেফতার করে ডিবি-র‌্যাব। এ ছাড়াও সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পালকেও গ্রেফতার দেখানো হয়।

কিন্তু দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সাগর-রুনির বাসার পলাতক দারোয়ান এনামুল হক ওরফে হুমায়ুনকে ধরতে পারলে হত্যাকাণ্ডের রহস্যজট খুলে যাবে।’ এজন্য এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এনামুলকে গ্রেফতার করা হলেও খোলেনি রহস্যজট। এখনো অধরাই থেকে গেছে প্রকৃত খুনিরা।

‘র‌্যাব চাইলে আসামিদের আটক করতে পারে, কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকায় আসামিদের আটক করা হচ্ছে না’ বলে অভিযোগ করেছেন সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির।

তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘বিচার পাব না। ওপরের চাপ থাকলে বিচার পাওয়া যায় না। এখন আর বিচারের আশা করি না। পাঁচ বছরে অনেক তদন্ত হলো, কিছুই বের হলো না- এটাও বিশ্বাস করি না। আমার সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর কতকিছু দেখলাম। আমি একা মানুষ, আমার ক্ষমতা নেই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, কিন্তু আমি নির্বোধ না। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে। তাদের ইশারায় সবকিছু হচ্ছে।’

‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে’- র‌্যাবের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, ‘৫ বছরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দিতে পারেনি। তাহলে তো বোঝা যায়, তারা কতটা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। এই তদন্তের ফল পেতে চাইলে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে এটুক মনে হয় সবসময়। সরকার চাইলে আমি বিচার পাবো, এ বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি। তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর আমার আর ভরসা নেই। তারা তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এ আশা এখন করতে পারছি না। এখন আল্লাহই শুধু ভরসা।’

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জেডটি/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর