thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

‘সৌন্দর্য বর্ধনে’ কাটা পড়ছে রমনার গাছ

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ১৫ ২১:৩৮:৫০
‘সৌন্দর্য বর্ধনে’ কাটা পড়ছে রমনার গাছ

রাজধানীর রমনা পার্কের ‘সৌন্দর্য বর্ধনে’ কাজ শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ‘অপরিকল্পিতভাবে’ লাগানো গাছ কাটার কাজ।

গণপূর্ত বিভাগ এ উদ্যোগ নিয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রমনা পার্ক নিয়ে একটি জরিপ করা হচ্ছে। এ জরিপ মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় গাছ অপসারণ করে পরিকল্পনা মোতাবেক সুনির্দিষ্ট বৃক্ষরোপণ, উন্মুক্ত স্থান নির্ধারণ, প্রতিটি গাছের ইতিহাসসহ পরিচিতি ফলক লাগানো এবং অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা অপসারণ করা হবে।

এতে রমনা পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে ঐতিহ্য সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণও হবে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

রমনা পার্ক নিয়ে জরিপের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই গাছ কাটা শুরু হয়েছে। গাছ কাটার মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের বিষয়টিকে অনেক প্রকৃতিপ্রেমী সন্দেহের চোখে দেখছেন।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্কে বিভিন্ন সময়ে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া পুরনো কিছু গাছে পোকা ধরায় সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য এগুলো অপসারণ করতে হচ্ছে।

রমনা পার্কে টয়লেটের কাছে বড় একটি চাম্বুল গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। বকুল তলার দিকেও একটি বড় গাছ কাটা হয়েছে। লেকের পাড়ে বাঁধানো গাবতলার কংক্রিট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জানা গেছে, আরও কয়েকটি পুরনো রেইনট্রি গাছও কাটা হবে।

রমনা পার্কে নিয়মিত ব্যায়াম করেন সোয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান খবীর উদ্দিন খান। তিনি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘সৌন্দর্য বর্ধনের যে কথা বলা হচ্ছে সেটা ভাল কথা। তবে গাছের বিষয়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের এক্সপার্টিস (বিশেষ জ্ঞান) থাকার কথা নয়। তবে প্রকৃতিবিদদের পরামর্শে এটা করলে ঠিক আছে। তবে এ বিষয়ে একটি গণশুনানিও দরকার। আমরা কিছু নই, কিন্তু এ পার্কটাকে আমরা ভালবাসি।’

সকালে ব্যায়ামের পর গাবতলায় ‘ক্ষণিকের মিলন’ এর লোকজন আড্ডা দিতেন, গান গাইতেন। ‘ক্ষণিকের মিলন’ও গড়েছেন খবীর উদ্দিন।

তিনি আরও বলেছেন, ‘গাবতলাটা এভাবে তছনছ না করলে কি হতো না? আমি বিষয়টিকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখছি। আমরা তো এখানে খারাপ কিছু করছিলাম না। আমাকে বলা হয়েছে, সংস্কারের জন্য পর্যায়ক্রমে সব গাছের কংক্রিটের বাঁধানো তলা ভেঙ্গে ফেলা হবে। কাজটি সঠিক হয়নি।’

রমনা পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তখনকার অতিরিক্ত সচিব এম বজলুল করিম চৌধুরীর (বর্তমানে রাজউকের চেয়ারম্যান) সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। এ সভায় রমনা পার্কের উন্নয়নে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রধান করে সাত সদস্যের ডিজিটাল সার্ভে কমিটি করা হয়।

কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- স্থাপত্য অধিদফতরের উপ-প্রধান স্থপতি সৈয়দ আমিনুর রহমান, গণপূর্ত আরবরিকালচারের প্রধান বৃক্ষ পালনবিদ, বিশিষ্ট গবেষক দ্বিজেন শর্মা, স্থপতি মুসতাক কাদরী, স্থপতি তুগলক আজাদ ও উদ্ভিদবিদ শরিফ হোসেন সৌরভ।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-কে জরিপ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিইজিআইএস-কে ৬ মাসের মধ্যে জরিপ শেষ করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়েছে, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে সংস্থাটি জরিপ কাজ শেষ করবে। কিন্তু জরিপ শেষ হওয়ার আগেই গত ৪ ফেব্রুয়ারি পার্কে একটি পয়েনসেটিয়া গাছের চারা লাগিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন সৌন্দর্য বর্ধন কাজের উদ্বোধন করেন। ওই সময় মন্ত্রীও অপ্রয়োজনীয় গাছ অপসারণের কথা জানিয়েছিলেন।

জরিপ প্রকল্পের নেতৃত্ব দেওয়া সিইজিআইএস-এর জীববৈচিত্র্য গবেষক মো. শরিফ হোসেন সৌরভ দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘আমরা জরিপের মাধ্যমে পার্কের গাছপালার প্রকৃতি, উচ্চতা, গাছের স্বাস্থ্যের অবস্থা, কি কি পশুপাখি আছে- এসব তথ্য নেব। দেখা গেছে একটা গাছের গোড়ায় চারটা গাছ রয়েছে, এগুলোর তো দরকার নেই। কোন কোন গাছ অপসারণ করতে হবে সেটাও আমরা সুপারিশে বলব। কমিটি সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

সাত সদস্যের ডিজিটাল সার্ভে কমিটিরও সদস্য শরিফ হোসেন আরও বলেছেন, ‘এ পার্কে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়নি। এক জায়গায় ৫ ধরনের গাছ আছে, আবার একই গাছ এক জায়গায় ৫টা, ১০টা এমনও আছে। কিছু গাছের ছায়ায় অন্য গাছ হয় না, ওই ধরনের গাছ অপসারণ করতে হবে। আবার পরিকল্পনা করে যেটা যেখানে প্রয়োজন লাগানো হবে। কিছু গাছ সরিয়ে লাগানো যেতে পারে। অনেক ধরনের কৌশলই আছে।’

কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘আমরা কিছু কিছু গাছের ডাল কাটছি। কয়েকটি গাছ খুব বিপজ্জনক, যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারে, সেগুলো কাটা হচ্ছে। পুরনো কয়েকটি গাছ আছে যেগুলো বিপজ্জনক। গত বছর একটা মহুয়া গাছ পড়ে গেল। আমরা কিছু নতুন গাছও লাগাচ্ছি।’

এ গবেষক আরও বলেছেন, ‘মেহগনি, রেইনট্রিসহ অপ্রয়োজনীয় অনেক গাছে পার্ক ভরে গেছে। সাধারণত পার্কে এ গাছগুলো থাকে না, অন্যান্য গাছ থাকে। তবে অপ্রয়োজনীয় সব গাছ আমরা কাটব না। বেশিরভাগ ডালপালা কেটে ফাঁকা করার চেষ্টা করব। জরিপ শেষ হওয়ার পর বোঝা যাবে কতগুলো গাছ কাটা হবে।’

বর্তমান অবস্থায় পুরো রমনা পার্ককে পরিকল্পনায় নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না জানিয়ে নিসর্গবিদ শর্মা বলেছেন, ‘পার্কে গাছপালা এমন অপরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে যে, এত গাছও কাটা যাবে না। যথাসম্ভব রেখেটেখে যতটুকু পারা যায় সংস্কার করা হবে।’

ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কমিটির প্রধান উৎপল কুমার দে গাছ কাটার বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘আপনি মনে হয় দেখেছেন একটি গাছ কাটা হয়েছে। উপরের মহল থেকেই বলা হয়েছে এ গাছটি রাখা ঠিক হবে না। এটা পড়ে মানুষ আহত হতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোনো গাছ কাটার সুযোগ নেই।’

এ প্রকৌশলী বলেছেন, ‘সার্ভেটা চলছে, সিইজিআইএস এটা করছে। তাদের রিপোর্টটা আমার রিভিউ করব। আমাদের অবজারভেশন থাকলে তাও দেব। চূড়ান্ত রিপোর্টের আগে আরও অনেক কাজ রয়েছে। জরিপের কাজটা আরেকটু এগুলে এটা নিয়ে কথা বলা যাবে। আরও কয়েক মাস লাগবে। আমরা এখনও কিছুই জানতে পারিনি।’

কমিটির সদস্য স্থাপত্য অধিদফতরের উপ-প্রধান স্থপতি সৈয়দ আমিনুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জরিপ করে আমাদের (কমিটি) কাছে প্রতিবেদন দেবে। জরিপের তথ্য আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে পার্ক সংস্কারের বিষয়ে সুপারিশ করব।’

ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো এখনই কেটে ফেলা হচ্ছে জানিয়ে জরিপ দলের প্রধান শরিফ হোসেন বলেছেন, ‘পার্কে অনেক ফিজিক্যাল স্ট্রাকচারও রয়েছে। নিজেরা টাকা দিয়ে বানিয়ে ব্যায়াম করছে, অনেকে প্রভাব খাটিয়ে এটা করছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো পার্কে আমি এ ধরনের স্ট্রাকচার দেখিনি। গাছের গোড়ায় দেয়াল তোলা হচ্ছে, সিঁড়ি তৈরি করা হচ্ছে।’

‘সব গাছের গোড়ার স্থাপনা সরানো হবে। কারণ এগুলো গাছ নষ্ট করে দেয়। ইটের দেয়ালের কারণে অনেকগুলো অশোক গাছ মরে গেছে’ বলেন শরিফ।

গত বছরের ৩০ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের ফলে রমনা পার্কের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে অনেক দুর্লভ বৃক্ষ ও তরুলতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পার্কের ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এ সব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ হকারদের উপদ্রবে রমনা পার্কের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে।

রমনা পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, ঐতিহ্য সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনকে এদিন বা অন্য সময়ে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/জেডটি/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর