thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড

প্রকাশ্যে ঘুরছেন ফাঁসির আসামি, খুঁজে পায় না ইন্টারপোল

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯ ২২:৫০:২৭
প্রকাশ্যে ঘুরছেন ফাঁসির আসামি, খুঁজে পায় না ইন্টারপোল

দেশের বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির আসামি জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব নুরুল ইসলাম দিপু প্রকাশ্যে ঘুরছেন। বেলজিয়াম ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয় পার্টি এবং সামাজিক নানা কর্মসূচিতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছেন তিনি। বিগত ২০০৯ সাল থেকে তাকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলের রেডএলার্ট রয়েছে। রেডএলার্ট রয়েছে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আরেক আসামি সৈয়দ আহম্মেদ মজনুর বিরুদ্ধেও। মজনুর অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও দিপু যে ইউরোপের কোনো এক দেশেই আছেন তার কিছু তথ্য প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যমেও দিপুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছবি সম্বলিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে মাঝে মধ্যেই। কিন্তু, রেডএলার্টের দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছরেও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল দিপুর অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারেনি। ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘তাদের (দিপু ও মজনু) অবস্থান শনাক্ত হওয়া মাত্র দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৪ সালের ৭ মে বিএনপি-জোট সরকারের আমলে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় গাজীপুর-২ আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে খুন হন ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন। ঘটনার পরদিন আহসান উল্লাহ মাস্টারের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম দিপুসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

এদিকে, শ্রমিকনেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইউরোপে পাড়ি জমান নুরুল ইসলাম দিপু। তিনি বিদেশে পলাতক থাকা অবস্থায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে নুরুল ইসলাম দিপুসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান অন্য দুজন। এরই মধ্যে ২০০৯ সালে দিপুসহ বিদেশে পলাতক আরেক আসামি মজনুকে গ্রেফতারে রেডএলার্ট জারি করা হয়। আসামিদের হাইকোর্টে আপিলের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৫ জুন উচ্চ আদালত রায়ে নুরুল ইসলাম দিপুসহ ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। যাবজ্জীবন দেন সৈয়দ আহাম্মেদ মজনুসহ ৮ জনকে। উচ্চ আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রায়ের এক সপ্তাহের মাথায় ইউরোপে পলাতক থাকা নুরুল ইসলাম দিপুকে জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে মনোনয়ন দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

চলতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে মো. জাহিদ আহসান রাসেল (গাজীপুর-২) প্রশ্ন করেন তার পিতার হত্যাকারী বিদেশে পলাতক খুনিদের কবে নাগাদ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানান, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের আসামি (১) নুরুল ইসলাম দিপু, (২) সৈয়দ আহাম্মেদ মজনুদের গ্রেফতারের নিমিত্তে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপারের (বিশেষ শাখা) কার্যালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে এনসিবি-ঢাকা এর অনুরোধক্রমে ইন্টারপোল সদর দফতর হতে একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর দিপু এবং মজনুর বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। বর্তমানে রেড নোটিস দুটি ইন্টারপোল ১-২৪/৭ নেটওয়ার্ক এবং পাবলিক ওয়েবসাইটে বিশ্বব্যাপী আসামিদ্বয়ের শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারের নিমিত্ত প্রকাশিত রয়েছে। রেড নোটিসধারী এ দুই আসামির অবস্থান শনাক্ত করার লক্ষ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। তাদের অবস্থান শনাক্ত হওয়া মাত্র দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মৃত্যুদণ্ড থেকে শাস্তি কমিয়ে হাইকোর্টের রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত মজনুর অবস্থান জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দিপু বর্তমানে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বসবাস করছেন। মাঝে মধ্যে ফ্রান্সসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশেও ঘুরে বেড়ান। অংশ নেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ সিঙ্গাপুরে ঘুরে যান দিপু।‘দিপু সমর্থক ফোরাম-সিলেট’ নামে একটি ফেসবুক পেজে এদিন (১ ফেব্রুয়ারি) দিপুসহ আরও দুই যুবকের ছবি পোস্ট দেওয়া হয়। এতে লেখা হয় ‘নুরুলইসলাম দিপু ভাই এখন সিংগাপুরে...!’। একই ফেসবুক পেইজ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি দেওয়া মিটিংয়ের ছবি সম্বলিত স্ট্যাটাসে বলা হয়, ‘সিংগাপুরে জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সাংগঠনিক আলোচনা আর খুশগল্পে সাবেক সফল ছাত্রনেতা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ন-মহাসচিব জননেতা Nurul Islam Dipu ভাই।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি দিপুর ছবিসহ একটি স্ট্যাটাস দেওয়া ‘দিপু সমর্থক ফোরাম-সিলেট’। এতে বলা হয়েছে, ‘বেলজিয়ামের উদ্দেশ্য সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাবেক সফল ছাত্রনেতা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব Nurul Islam Dipu ভাই।’

বিদায়ী ২০১৬ সালের ২২ জুন নুরুল ইসলাম দিপুকে জাপার যুগ্ম মহাসচিব পদে মনোনয়ন দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এদিন তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে ২৩ জুন অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে ‘আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকারী দিপু জাপার যুগ্ম মহাসচিব’ (আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকারী দিপু জাপার যুগ্ম মহাসচিব ) শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দিপু ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে দলীয় এবং ব্যক্তিগত সফর বাড়িয়ে দেন। গত ১ জানুয়ারি ফ্রান্স জাতীয়পার্টি আয়োজিত পার্টির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (প্যারিসের গার্দ নর্দে অভিজাত রেস্টুরেন্ট মাদারজে) প্রধান অতিথি ছিলেন নুরুল ইসলাম দিপু। সেখানে প্রবাসী জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নিয়ে কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেন তিনি।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর বেলজিয়াম শাখা জাতীয় পার্টির উদ্যোগে মহান বিজয় দিবসের এক আলোচনা সভা শেষে বেলজিয়াম শাখা জাতীয় পার্টির নতুন কমিটি ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ও আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নুরুল ইসলাম দিপু।

এদিকে নুরুল ইসলাম দিপু গাজীপুরের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার প্রধান আসামি হলেও জাতীয় পার্টি ও এর অঙ্গ সংগঠন দিপুর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা হিসেবে অভিহিত করছে। ‘দিপু সমর্থক ফোরাম’সহ বিভিন্ন নামের ফেসবুক পেজেও দিপুকে নির্দোষ হিসেবে দাবি করে তার বিরুদ্ধে আনিত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে।

এমন কি আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান আসামি দিপুর পক্ষে বিভিন্ন সময় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। তেমনই একটি সভার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা ইন্টারনেটে এখনও বিদ্যমান। ২০১৪ সালে এক জনসভায় দিপু সম্পর্কে এরশাদ বলেন, ‘আমি দিপুকে চিনি। নির্দোষ ছেলে সে। ষড়যন্ত্র করে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সুযোগ হলে আমি দাবি করব, আবার বিচার করা হোক। আবার বিচার করা হবে।’ দিপু সুবিচার পায়নি বলেও দাবি করেন এরশাদ।

এ ব্যাপারে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে এবং তার আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গাজীপুর-২, টঙ্গী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি আহসান উল্লাহ মাস্টারের মৃত্যুর পর এখন তার ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল ওই আসনের সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর