thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

স্মরণের ফুলে ভরে গেছে স্মৃতির মিনার

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ২১ ০৮:০৫:১১ ২০১৭ ফেব্রুয়ারি ২১ ১১:৪৫:০০
স্মরণের ফুলে ভরে গেছে স্মৃতির মিনার

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : বুকের রক্ত দিয়ে যারা মায়ের ভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসন দিয়ে গেছেন, সেই ভাষা শহীদদের ভোলেনি জাতি। আত্মত্যাগের সেই দিনটিতে স্মরণের ফুল হাতে শহীদ মিনারে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। গভীর রাতও বাধা হয়নি সেই কৃতজ্ঞ স্মরণে। ১৯৫২ সালের ভাই-হারা শোকার্ত জাতির সব পথ যেন মিশেছে শহীদ মিনারে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরেই শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে গেছে স্মৃতির মিনার।

ভাই-হারা শোক শক্তিতে জাতি আরেকবার শাণিত হচ্ছে দেশকে এগিয়ে নেওয়া দৃপ্ত শপথে।

বাংলাদেশের শহীদ দিবস হলেও সারা বিশ্ব একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’-সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ও আলতাফ মাহমুদের সুর করা অমর এ গান প্রভাতফেরি থেকে শুরু করে শোক ছড়িয়ে বাজছে সবখানে।

মঙ্গলবার একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর জনতার ঢল নামে শহীদ মিনারে। গায়ে গায়ে শোকের প্রতীক কালো পোশাক, কালো ব্যাজ। কালো রঙের ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ।

লম্বা সাঁড়িতে দাঁড়িয়ে একে একে এই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন।

রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর তারা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর দলীয় সভাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির পর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা। এ সময় কূটনৈতিকদের সঙ্গে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

মন্ত্রিসভার সদস্য, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

এ ছাড়া ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। ঢাবি শিক্ষক সমিতিও আলাদাভাবে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের নেতৃত্বে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে রাত সোয়া ১২টার দিকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাত দেড়টার দিকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় দলটির সিনিয়র নেতা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। রাত গভীর থেকে প্রভাতের দিকে এগিয়ে গেলেও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত মানুষের ভিড়ও বাড়তে থাকে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। রাতে এমনকি সকাল হওয়ার পর শিশুদেরও শহীদ মিনারে ফুল দিতে দেখা যাচ্ছে।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রোভার স্কাউটের বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ করছে। এ ছাড়া যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশ ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

প্রথম প্রহরেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বামপন্থী বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা।

সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের প্রধানের নেতৃত্বে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ একুশের প্রথম প্রহরেই পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন, রোভার স্কাউট, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। সবাই কালো ব্যানার নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন একের পর এক।

সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও একুশের প্রথম প্রহরে শহীদদের সম্মানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এ ছাড়া ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

দেশ বিভাগের পর বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে যে ভাষা চেতনা বেড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের কূটকৌশলের মধ্যে এ চেতনা পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টার মধ্যে ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, সফিউরসহ কয়েকজন তরুণ শহীদ হন।

বলা হয়ে থাকে, ভাষা আন্দোলনের পূর্ণতায়ই বপিত হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণার বীজ।

ভাষা শহীদদের আত্মদান এখন বিশ্ব চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম প্রথম তখনকার জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, সেমিনার, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ দেশব্যাপী নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। মঙ্গলবার দেশে সাধারণ ছুটি।

একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংলা বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে।

আজিমপুর ও বায়তুল মোকাররমে দোয়া

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান। মোনাজাতে ভাষা আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এর আগে সকাল ৮টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আজিমপুর কবরস্থানে সকল ভাষা শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কোরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/আরএমএম/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর