thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

আজও স্বীকৃতি মেলেনি চারণ কবি শামসুদ্দিনের

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ২১ ১৮:০০:৫৮
আজও স্বীকৃতি মেলেনি চারণ কবি শামসুদ্দিনের

ইমরুল কায়েস, বাগেরহাট : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন সারাদেশ উত্তাল, মায়ের ভাষার স্বীকৃতি পেতে বাংলার দামাল ছেলেরা ১৪৪ ধারা ভেঙে যখন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, ভাষার জন্য রাজপথে অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে তখন অজোপাড়াগাঁর গরীব কৃষকের ছেলে চারণ কবি শামসুদ্দিনও অশান্ত হয়ে ওঠেন। সেদিন তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনি বাগেরহাটে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য রাজপথে নেমে পড়েন। এই অশান্ত স্বশিক্ষিত শামসুদ্দিন নিজে রচনা করেন বিদ্রোহের গান। ২১শে ফেব্রুয়ারিরাতেই শামছুদ্দিন আহমদ রচনা করেন ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটি।

পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন শেষে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক (সিসি ব্যাংক) মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেন ছাত্র-জনতাকে।

জানা যায়, সে সময় তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে তার রচিত রাষ্ট্রভাষা’ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন। তার এ গান এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে স্বল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

তার লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি গেয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন তিনি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শেষে তার রচনা করা গানটি আমাদের দেশের গুণি শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয়েছে। এই গানটি এখনো সবার মুখেমুখে ফেরে। তবে তিনি বেঁচে থাকতে তো দূরের কথা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পার হলেও সেভাবে মেলেনি তার কোন স্বীকৃতি।

১৯৭৪ সালে চারণ কবি শামসুদ্দিনের জীবনাবসান হয়। স্মৃতি হিসেবে চারণ কবি শামসুদ্দিনের ব্যব‎হৃত একটি একতারা রয়েছে।

বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কের পাশে বাগেরহাটের ফতেপুর গ্রামে শামসুদ্দিনের বাড়ি। শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছোট ছেলে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এবং বড় ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিরা গ্রামেই বসবাস করছেন। অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখা শিখতে পারেনি।

তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে (বর্তমান- বাগেরহাট বহুমুখি কলেজিয়েট স্কুল)। এখান থেকেই তিনি জুনিয়র পাস করেন। তবে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুযোগ হয়নি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের।

ছেলেবেলা থেকেই কবিতা ও গানের প্রতি অসাধারণ ঝোঁক ছিল শামছুদ্দীন আহমেদের। বাল্যকাল থেকে তিনি ভক্ত ছিলেন পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের। পেশায় ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসয়ী। কেউ কেউ তাকে তেল বিক্রেতা বলে উল্লেখ করেন।

চারণ কবি শামছুদ্দীন আহমেদের বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন জানান,বাবা হাটবাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন আর গান বাঁধতেন। আমার বাবা গরীব ছিলেন। অভাবের কারণে আমরা লেখাপড়া শিখতে পারিনি। তিনি রাষ্ট্রভাষার একজন সংগ্রামী সিপাহী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার রচনা করা গান সবার মুখে মুখে। ভাষা আন্দোলনে তার যে অবদান ছিল তার স্বীকৃতি সেভাবে মেলেনি। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমার বাবা যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান।’

জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে শামসুদ্দিনের বেড়ে ওঠা। তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়ালেখা করেছেন। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে তা আর বেশিদূর এগোয়নি। তাই তাকে নেমে পড়তে হয় উপার্জনের পথে।

ড. শেখ গাউস মিয়ার মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ বাগেরহাট নামে লেখা বইটিতে শামসুদ্দিনের রচনা করা গানটি স্থান পেয়েছে। এই গানটির কথা উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীও। যা গাউস মিয়ার বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন।

‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি তিনি প্রথমে নিজের মতো করে লোকসুরে গেয়েছিলেন। পরবর্তীতে গানটির সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং প্রথম কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা হলেও তার গান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের।

স্থানীয় প্রশাসন স্বীকৃতি হিসেবে গ্রামের বাড়িতে যেখানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে সেই কবরটি সংরক্ষিত করে তা বাঁধিয়ে দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের জন্য বাগেরহাট ফাউন্ডেশন ও মোবাইল ফোন অপারেটর নামে একটি সংগঠন মরণোত্তর সনদ ও ক্রেস্ট দিয়েছে তার পরিবারকে।

চারণ কবি শামসুদ্দিনকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

বাগেরহাট সামছুদ্দিন নাহার ট্রাস্ট্রের প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জি বলেন, ১৯৫৩ সালে ‘পাকিস্তান পল্লীগীতি’ নামে খুলনা থেকে ১৬টি গানের সংকলন বের করেন কবি শামছুদ্দীন আহমেদ। রাষ্ট্রভাষা গান, একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রভাত ফেরীসহ ১৬টি গান। এর মধ্যে দুটি গানের সুরকার ডিএল রায়। বইটির প্রশংসাপত্র লেখেন কবি জসিম উদ্দিন। এই গানের সংকলনটি অমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আমরা বই পড়ে ও তার ইতিহাস যতটুকু জেনেছি তিনি একজন বড় মাপের কবি ছিলেন। তার লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি গানের কয়েকটি লাইল হলো, ‘এমন দিনে তরুণ খুনে লাল হলো ভাই আমার দেশ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে করিলি ভাইয়ের মরণ দেশ, কাঁদিয়া উঠিল মিনার গম্বুজ, কাঁদিয়া উঠিল সারাটি দেশ, অসহায় শিশু মাতৃহারা কাঁদিছে যেন শিশুর মেষ।’

বাগেরহাটের অধ্যাপক বুলবুল কবির বলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম কবি শামছুদ্দীন আহমেদ ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হলেই গলায় হারমনি ঝুলিয়ে বিভিন্ন থানায়, সভায় চোখের জল ফেলে ‘রাষ্ট্রভাষা’ গানটি পরিবেশন করতেন। এছাড়া তিনি আরও অনেক গান পরিবেশন করতেন।’

বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, কবি শামসুদ্দিনের পরিবারের প্রত্যাশা এই কালজয়ী সংগীত রচনা এবং আন্দোলনকে বেগবান করার যে ভূমিকা সেটি যাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়। আমি তাদের দাবির সাথে একমত পোষণ করছি। সারাদেশে ভাষা সৈনিকদের সম্মানিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তেমনিভাবে এই গানের রচয়িতা কালজয়ী কবিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা বাগেরহাটবাসি তাকে নিয়ে গর্বিত। আমরা ছোটখাট স্বীকৃতি দিয়েছি যেটা তার জন্য সম্মানজনক নয়। আমি আশা করি ভাষা আন্দোলনের মাসে তার প্রতি যেন সরকার আন্তরিক হয়ে তার কর্মের স্বীকৃতি দেয়। এটাই আমি দাবি করছি।

(দ্য রিপোর্ট/এমএইচএ/এপি/ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর