thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ 24, ১৪ চৈত্র ১৪৩০,  ১৮ রমজান 1445

হাকিম নড়ে, হুকুমও নড়ে!

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ২২ ২৩:৪১:৪৫
হাকিম নড়ে, হুকুমও নড়ে!

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব, খুলনা ব্যুরো : কথায় বলে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। তবে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ ) ক্ষেত্রে কথাটি বুঝি বিপরীত। সেখানে ‘হাকিম নড়লে হুকুমও নড়ে’! ঠিক যেমনটা ঘটেছে এম এ বারী সড়কের বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ২৭টি প্লট নিয়ে।

২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন চেয়ারম্যান বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সামছুল আলম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেডিএ’র ৫২৬তম বোর্ড সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এ প্লটগুলোর বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সামছুল আলম খান কেডিএ চেয়ারম্যান পদ থেকে বদলি হন। তার জায়গায় দায়িত্ব নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসানুল হক মিয়া। চেয়ারম্যানের এই বদলির সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখিত প্লটগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্তও বদলে গেছে। পুরনো মালিকদের কাছেই সেগুলো আবার ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। এতে কেডিএ’কে গুনতে হচ্ছে ২৩ কোটি টাকার আর্থিক লোকসান।

অবশ্য কেডিএ’র লোকসান হলেও প্লটগুলো পুনরায় বরাদ্দের এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান (আর্থিকভাবে) হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন- কেডিএ’র এই আর্থিক লোকসানের ঘটনাটি সরকারি আশির্বাদপুষ্ট ব্যক্তিদের তুষ্ট করতে এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাইকে সুযোগ দিতেই করা হয়েছে।

খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সামছুল আলম খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ৫২৬তম বোর্ড সভায় (২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি) এম এ বারী সড়কের বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ২৭টি প্লট সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল করা হয় । সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ২০১৫ সালের ৩০ জুন তারিখের মধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্তরা বকেয়াসহ সকল পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে তাদের নামে বরাদ্দকৃত প্লট বাতিল হয়ে যাবে। যা সেই সময় তাদের (প্লট মালিকদের) লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। পরবর্তী বোর্ড সভায় সেটিও সর্বসম্মতিক্রমে নিশ্চিতকরণ করা হয় । কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেউ টাকা পরিশোধ না করায় বাতিল হওয়া প্লটগুলোর জন্য পুনঃটেন্ডার আহ্বান করা হয় । এই টেন্ডারে ইতোপূর্বে সর্বোচ্চ দর কাঠা প্রতি ২৪ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ লাখ টাকায় ওঠে। মোট একশত কাঠার জমিতে পূর্বের চেয়ে নতুন দর বৃদ্ধি পায় মোট ২৩ কোটি টাকা ।

তবে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সামছুল আলম খান বদলি হলে নতুন কেডিএ চেয়ারম্যান হিসাবে যোগদান করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসানুল হক মিয়া । অভিযোগ রয়েছে, জমির দাম বৃদ্ধির ফলে পুরাতন প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের কয়েকজন কেডিএ বোর্ড সদস্যদের সাথে ‘গোপন লেনদেনে’ একটা সমঝোতা করেন। ওই বোর্ড সদস্যরা ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত ৫৩৭তম বোর্ড সভায় কেডিএ’র আর্থিক গচ্চার বিষয়টি ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পুরাতন প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের পক্ষে সুপারিশ করেন। এরপর এ বিষয়ে একটি চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত টিম গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হন ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আকরাম হোসেন, যিনি ইতোপূর্বে বোর্ড সদস্য হিসাবে প্লট বাতিলের পক্ষে একমত পোষণ করেছিলেন।

“কেডিএ’র বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাম আবাসিক এলাকার বাতিলকৃত ২৭টি প্লটের বিষয় সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠিত কমিটি” ২৭টি প্লটগৃহীতাদের মধ্যে ২২জনের প্লট পুরাতন দরে (কাঠা প্রতি ৪৭ লাখ টাকার স্থলে কাঠা প্রতি ২৪ লাখ টাকা দরে) বরাদ্দ বহাল রাখার সুপারিশ করে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। অথচ তালিকাভুক্ত ২৭ প্লট গৃহীতার কেউই নির্দিষ্ট সময় প্রিমিয়ামের (কিস্তির) অর্থ বিধি-বিধান মতো কেডিএ’তে জমা দেননি।

অভিযোগ রয়েছে, গঠিত কমিটি তড়িঘড়ি করে প্রতিবেন দাখিল করে, যেখানে বলা হয়-কেডিএ’র বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাম আবাসিক এলাকার প্রিমিয়াম খেলাপী বাতিলকৃত ২৭টি প্লটের মধ্যে ২২টি প্লটের বাতিল আদেশ প্রত্যাহারসহ বকেয়া প্রিমিয়াম অর্থ ১৫ % মূল্যসহ পরিশোধ এবং সুদাসলে পাওনা টাকার ওপর ৫% জরিমানা পরিশোধ করার জন্য আগামী ৩০ জুন ২০১৭ ইং পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হলো ।

এই সুপারিশ বোর্ড সভায় উপস্থাপিত হলে কেডিএ’র অন্যতম সদস্য আলহাজ্ব মো. আশরাফুল ইসলাম এই সুপারিশের বিরোধিতা করেন। তিনি জানান, যে বোর্ড সভায় এই প্লট বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছিল সেই সভায় এই কমিটির সকল সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে কেডিএ চেয়ারম্যান বোর্ড সভার সদস্যদের লিখিত আপত্তি দাখিলের জন্য ৩ দিন সময় দেন। আশরাফুল ইসলামের সাথে কেডিএ’র সরকারি এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সদস্যরা কমিটির সুপারিশের বিরোধিতা করেন।

আশরাফুল ইসলামের ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর লিখিতভাবে গঠিত কমিটির সুপারিশের বিরোধিতা করেন। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন, এম এ বারী সড়কের প্লটের কাঠা প্রতি দর দেখানো হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা । সেখানে বাতিলের পর টেন্ডার আহ্বান করলে প্লটের কাঠা প্রতি দর ওঠে এক বছর আগে ৪৭ লক্ষ টাকা । যে দর ইতোমধ্যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে কেডিএ ২০১৫ সালের ৩০ জুন অনুষ্ঠিত ৫২৬তম বোর্ড সভায় ৫% জরিমানা আরোপের প্রথাটি বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর তারিখের ৫৩৮তম বোর্ড সভায় আলোচ্যসূচির ৩ এ (সুপারিশ) সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, যা কেডিএ’র ভাবমূর্তির সাথে একান্তভাবে জড়িত। এ ছাড়া প্রতিটি সভার সিদ্ধান্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়ে থাকে । প্রতিটি সভার সিদ্ধান্তের ওপরে পরবর্তীতে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা সংযোজন প্রয়োজন হলে সেটি বোর্ডের পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের এখতিয়ারাধীন । একইভাবে যে বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত বাতিলে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা শুধু কেডিএ বোর্ডের সাধারণ সদস্য নিয়ে করা হয়েছে । সেখানে কোনো টেকনিক্যাল অভিজ্ঞরা ছিলেন না । এই কমিটিতে কেডিএ’র বৈষয়িক শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অন্তভুক্ত না করায় সুপারিশ প্রতিবেদনে তথ্যবিভ্রাট পরিলক্ষিত হয়েছে । কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পূর্বের বরাদ্দপ্রাপ্তদের ফের পুরানা দরে প্লট দিলে কেডিএ এবং সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে ।

এ বিষয়ে আলহাজ্ব আশরাফুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘যাদের পক্ষে এই কমিটি পূর্বের দরে প্লট দেওয়ার সুপারিশ করেছে তাদের মধ্যে কমিটির সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন।’

তিনি দাবি করেন, তাকে এই সুপারিশের বিরোধিতা না করার জন্য কয়েকজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবে নানা প্রস্তাবও দিয়েছেন ।

তিনি কমিটির সুপারিশ করা রিপোর্ট দেখিয়ে বলেন, ‘পুরনো দরে বাতিল হওয়া বরাদ্দপ্রাপ্তদের প্লট দিলে কেডিএ ৩০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কেডিএর প্লট নং ১০ এর গ্রহীতা মেহেদী হাসান পারভেজ নির্দিষ্ট সময় ৫০% প্রিমিয়াম পরিশোধ না করায় তার প্লটের বাতিল করতে সুপারিশ করা হলো । আবার ডা. সৈয়দ আবু আসকরের ১৬৩ নং প্লট বরাদ্দ দিলে তিনিও নির্দিষ্ট সময় প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেও এই কমিটি তার বরাদ্দ বহাল রাখতে সুপারিশ করেছে। ২৭টি প্লটের মধ্যে যে ৫টির প্লট বাতিল করা হয়েছে তারাও কেউ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৫০% অর্থ জমা দেননি। অবার যে ২২জনের প্লট বরাদ্দ বাতিল আদেশ পুনর্বহাল করতে সুপারিশ করা হয়েছে তারাও কেউ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৫০% অর্থ পরিশোধ করেননি।’

কেডিএ’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, যে ২২ জনের প্লট বরাদ্দের আদেশ পুনর্বহাল করা হয়েছে তারা হলেন-নাজনীন আক্তার, শেখ আব্দুল মান্নান, আলহাজ্ব জাহিদুর রহমান, ডা. সৈয়দ আবু আসফার (৬টি), ডা. মো. রফিকুল হক, মো. আরশাদ আজম ও এম আই বাপ্পি, ডা. ফৌজিয়া বেগম, সঞ্চয় চক্রবর্তী, মো. আবু জাফর আহমেদ (২টি), ডা. এস এম আব্দুল মালেক, মেসার্স হক এন্ড স্টোরস, মো. কামরুজ্জামান, সৈয়দ রোকনউজ্জামান, সালমা আক্তার, মিসেস জোহরা খাতুন এবং নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম । অন্যদিকে, যে ৫ জনের প্লট বাতিল করা হয়েছে তারা হলেন-মনিরুল হকের (৩টি), মেহেদী হাসান পারভেজ ও মনিরা পারভিন আফসানা ।

প্রসঙ্গত, বাতিল করার পর পুনরায় যাদের প্লট বরাদ্দ করার সুপারিশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যর এক ভাইও রয়েছেন।

এ ব্যাপারে কেডিএ’র চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসানুল হক মিয়া এনডিসির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘৫২৬তম বোর্ড সভায় প্লট বাতিল হওয়া সিদ্ধান্ত সুপারিশ কমিটির সুপারিশে পুনর্বহাল করলেও সেখানে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি। যে সদস্য এই সুপারিশের বিরোধিতা করেছেন তা বোর্ড সভায় লিপিবদ্ধ হয়েছে । প্লট বাতিল করার পর টেন্ডারে যে দর উঠেছিল সেই মূল্য এবং যাদের ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পুনর্বহাল করা হয়েছে তাদের সুদাসল দিয়ে প্রায় একই রকম দর পড়েছে।’

‘হাকিম নড়ে গেলে হুকুমও বদল হয়ে গেছে’ এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি স্বীকার করেন যে পূর্বের বোর্ডসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত চেয়ারম্যান বদলের পর বোর্ডসভাতেই পরিবর্তন হয়ে গেছে । তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘প্লট পুনরায় বরাদ্দে কেডিএ কোনো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েনি।’

এ বিষয়ে ফুলতলা উপজেলার চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেনের সাথে মোবাইলে কয়েক দফা যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/এনআই/ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর