thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ৮ বছর পূর্তি

আইনী জটিলতায় ঝুলছে হাইকোর্টের বিচার

২০১৭ ফেব্রুয়ারি ২৪ ২৩:৩৯:২৪
আইনী জটিলতায় ঝুলছে হাইকোর্টের বিচার

আট বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ভয়াল সেই বিদ্রোহে বিডিআরে (বর্তমানে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ) কর্তব্যরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্ধশতাধিক চৌকস কর্মকর্তা বিপথগামী জওয়ানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেই বিদ্রোহের বিচার বিডিআর আইনে ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে, এ বিদ্রোহে হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী ঘটনার মতো অপরাধের বিচার হচ্ছে দেশের প্রচলিত আইনে। এই ঘটনায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতে ১৫২ জন আসামি মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মামলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রেকর্ড। এ ঘটনায় আরও ১৬১ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিল শুনানি এখন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে চলছে। এই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।

এই মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়। চলতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি ৩৫৯তম কার্যদিবস শুনানি শেষে আগামী ২ এপ্রিল শুনানির পরবর্তী দিন রেখেছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টে বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে অবশ্য কিছু আইনী জটিলতা উপস্থিত হওয়ায় খানিকটা ঝুলে গেছে বিচার প্রক্রিয়া। তবে সেসব জটিলতা নিরসন করে চলতি বছরেই বিচার শেষ করার আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।

ঠিক কি ধরনের আইনী প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে জানতে চাইলে ‍বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘একই সাক্ষীতে কিছু কিছু লোকের ফাঁসি, কিছু লোকের যাবজ্জীবন, কিছু লোকের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। এ সমস্ত বিষয়ে আদালতের প্রশ্ন আছে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আমাদের আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে।’

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূর করতে হলে সাজায় পরিবর্তন আসবে। এসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে যেসব খালাসপ্রাপ্ত বা কম সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন তাদের দণ্ড বৃদ্ধি করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষকে আপিল করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সেই আপিল করেনি। তাই আসামিপক্ষের দাবি এই বৈষম্য দূর করতে হলে এখন সর্বনিম্ন শাস্তি যাদের দেওয়া হয়েছে সেটাকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরতে হবে।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল জানালেন, তারা সেসব আসামির বিরুদ্ধে এখন আপিল করতে চান। যাতে খালাস বা কম দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘কিছু আসামি খালাস বা কম দণ্ড পেয়েছেন। একই অপরাধে কারও যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, বাকিগুলোরও ঠিক একইরকম দণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে কম দণ্ড দেওয়া হয়ে থাকলে সেগুলো দেখে দেখে কিছু আসামির বিরুদ্ধে আমরা ফের আপিল করব।’

আইনী এসব প্রশ্ন শেষ হতে কেমন সময় লাগবে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘এই মামলায় তো বহু আসামি। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মতো। বিষয়টি তো খুব তাড়াহুড়ো করে নিষ্পত্তি করা সম্ভব না। এর ভিতরে অনেক আসামি আছে তারা আইনগত নানারকম প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ইতোমধ্যে বিদ্রোহের ঘটনায় যাদের সাজা হয়েছে তাদের আবার এই মামলায় যদি সাজা হয় তাহলে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হবে কি না, এ ধরনের নানা প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই আদালত আমাকে ডেকে যেভাবে বলেছেন, তাতে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে। সুতরাং এ সমস্ত প্রশ্ন মিট করতে গেলে কিছু সময় তো লাগবেই।’

সব প্রশ্ন শেষ করে এ বছরের মধ্যেই হাইকোর্টে মামলার কার্যক্রম শেষ হবে বলেও আশা করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এই মামলার কয়েক শ’ আসামির মধ্যে ৩৭ জন আসামির পক্ষে আদালতে লড়ছেন আইনজীবী মো. শামীম সরদার। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, ‘এই মামলায় আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি কার্যক্রম শেষের পথে। প্রসিকিউশন তাদের সমস্ত শুনানি কার্যক্রম শেষ করেছে। আমরা আসামিপক্ষ থেকে শুনানি শেষ করে এখন আইনগত বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছি। আমাদের শুনানির পর রাষ্ট্রপক্ষ যদি জবাব দিতে চায় তবে তারা খণ্ডন করতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে এই মামলার হাইকোর্টে শুনানি কার্যক্রম শেষ হবে।’

আসামিপক্ষ হাইকোর্টে তথ্য-উপাত্ত (ফ্যাক্টস) ও আইন এই দুটি পয়েন্টে বক্তব্য রেখেছে। সেখানে কি ধরনের যুক্তি দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে শামীম সরদার বলেছেন, ‘ফ্যাক্টসের ক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, সমস্ত আসামিদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের অপরাধে কতটুকু অংশগ্রহণ আছে, অপরাধের গুরুত্ব কতটুকু, তারা পারসোনালি কোনো ভূমিকা রেখেছে কি না, তাদের যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সেটা আইনানুগভাবে রেকর্ড করা হয়েছে কিনা এসব বিষয়।’

‘ষড়যন্ত্র একই দলভুক্ত হয়ে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা, বিদ্রোহ ঘোষণা করা, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির যে রেকর্ডিং সিস্টেম এ সমস্ত বিষয়গুলো আমরা ল পয়েন্ট থেকে যুক্তিতর্কে উপস্থাপন করেছি’- যোগ করেছেন শামীম সরদার।

সব মিলিয়ে হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করছেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত জায়গা থেকে আমরা দেখিয়েছি একজন আসামি অপরাধের সঙ্গে কতটুকু জড়িত এবং কি পরিমাণ সাজা তাকে দেওয়া যায়, কীভাবে তাকে খালাস দেওয়া যায়। আমরা আশা করছি, ন্যায়বিচার পাব। অনেক আসামি খালাস পাবে, অনেকের দণ্ড কমে যাবে।’

আসামিপক্ষ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদকেও শুনানিতে টেনেছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না। তাছাড়া এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাইবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শামীম সরদার বলেছেন, ‘একটা সুশৃঙ্খল বাহিনী যদি কোনো অপরাধে জড়ায় তার জন্য আর্টিকেল ৩৫ ও ৪৭ প্রযোজ্য হয়ে যায়। কথা হলো, সেও কিন্তু সিভিলাইজড মানুষ। তার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। বিডিআরদের নিজস্ব আইন আছে, সেখানে সর্বোচ্চ আইন আছে সাত বছর। যার কারণেই কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট থেকে রেফারেন্স যাওয়ার পরই প্রচলিত আইনে বিচার চলছে। এই বিচারের ক্ষেত্রে আসামিরা যে সমান সুযোগ পেয়েছে সেই জিনিসটা কিন্তু রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে। যার জন্য আমরা সংবিধানকেও এখানে টেনেছি।’

আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামির অপরাধে সমান অংশগ্রহণ প্রমাণিত হয়নি। তাই হাইকোর্টে সেটার প্রতিকার পাওয়ার আশা করছেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক এই সভাপতি দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘আসামিদের যে একই ধরনের অংশগ্রহণ ছিল, তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়নি। এ ছাড়া অনেকে রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে খুন বা অন্য কোনো অপরাধের কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। আমরা আশা করছি, বিচারিক ইতিহাসে এই মামলাটি রেকর্ড হিসেবে থাকবে। এই মামলায় যেহেতু ঢালাওভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে, আশা করছি, আদালত সব বিষয় পর্যালোচনা করে রায় দেবেন।’

টানা ৮ বছরের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের দেড় মাসের মধ্যেই (২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরের ভেতরে ঐ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। যেই ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৪ জন নিহত হন।

পিলখানার অমানবিক ও ইতিহাসের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী এ ঘটনার দায়ে দেশের প্রচলিত আইনে ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় তৎকালীন ওসি নবজ্যোতি খীসা বাদী হয়ে কয়েকটি ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি পরবর্তীতে ঘটনাস্থল অন্য থানার আওতাধীন হওয়ায় ৪ মার্চ নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়।

এই ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা দুই মামলার তদন্ত শেষে সিআইডি ৮শ' ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১০ সালের ১২ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। অভিযুক্তদের মধ্যে বিডিআর জওয়ান ছাড়াও বিএনপির সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, তার ছেলে যুব লীগ নেতা লেদার লিটনসহ ২৩ জন বেসামরিক লোক রয়েছেন।

পরে এ বিদ্রোহের বিচারের জন্য বকশী বাজারে আলীয়া মাদরাসার পাশে বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় আরও ১৬১ জনকে। আরও অনেকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড পান।

এই বিদ্রোহের বিচার হয় ১৯৭২ সালের করা বিডিআর আইনে। বিডিআর বিদ্রোহে ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে তিন বছর ধরে চলা বিশেষ আদালতগুলোতে ৫৭টি মামলায় মোট ৬ হাজার ৪৬ জন জওয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার হয়। এর মধ্যে সব মিলে ৫ হাজার ৯২৬ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, বাকিদের কয়েকজন মারা গেছেন। ১১৫ জনকে অভিযোগ না প্রমাণ হওয়ায় বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

এই বিদ্রোহের পর বিডিআর ভেঙ্গে দিয়ে এই বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নতুন নাম রাখা হয় বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ (বিজিবি)।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/এনআই/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর