thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ !

২০১৭ মার্চ ০১ ২৩:১৮:২৩
আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ !

বিরোধীদলের সৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে-বারবার এমন দাবি করে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার। তবে বিরোধী দলীয় প্রতিবন্ধকতা নাকি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বড় সমস্যার সৃষ্টি করছে, সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের অবরোধ কর্মসূচির পর এই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকাশ্যেই এ নিয়ে আলোচনার জন্ম হয়েছে।

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, ঠুনকো ইস্যুতে ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাত’ সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন আওয়ামী লীগ কর্মীরাই। যার সর্বশেষ চিত্র দেখা গেছে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে। এ ধর্মঘটকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারে শ্রমিকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অথচ নৌপরিবহন মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের কণ্ঠে মিলেছে ভিন্ন সুর। বিষয়টিকে শ্রমিকদের ধর্মঘট মানতে নারাজ তিনি। তার মতে, এটা ছিল শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে যাওয়া। বুধবার ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর শ্রমিকদের হয়ে জনগণের কাছে (তাদের ভোগান্তিতে পড়ার কারণে) দুঃখও প্রকাশ করেছেন শাজাহান খান।

কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদকের কথার বিপরীতে শাজাহান খানের কথা বা ভূমিকায় যেন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতার চিত্রই প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে দলে ব্যক্তি আধিপত্যের দ্বন্দ্বও যেন স্পষ্ট হয়ে গেছে! যা বিপাকেই ফেলছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। এতে করে দেশের ক্ষতি সাধন হচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলো প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছে। বুধবার (১ মার্চ) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেমন বলেছেন, ‘পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে পেছনে যিনি মদদ জোগাচ্ছেন তিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। আজকে এভাবে একটি অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে দেশব্যাপী পরিবহন ধর্মঘটের মাধ্যমে গোটা দেশকে ধ্বংস করেছে। সরকার এই সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।’

ভোটের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারে আসীন একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় সংকট। এমন সংকটকে দলের অগ্রযাত্রার জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় নিয়ে তা সমাধানে মৌলিক জায়গা চিহ্নিত করে দলীয় পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের দাবি, এখনই দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ বের না করতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

তাদের দাবি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘অযৌক্তিক ধর্মঘট’ প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর পরও মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়নি। পরদিন (বুধবার) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়ুদল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম বক্স দুদু, শ্রমিক নেতা কাজী মোতাহার হোসেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ফারুক তালুকদার সোহেলকে নিয়ে বৈঠকের পর ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি আধিপত্যের বিষয়গুলো নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার জন্ম নেয়।

পরিবহন ধর্মঘটে যদি একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সম্পৃক্ততা না তাকে তাহলে তাদের ডাকেই কেন কর্মসূচি প্রত্যাহার হয় এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। তাদের দাবি, এবারের কর্মসূচি প্রত্যাহারই কোনো সমাধান নয়, বারবার এমনটা ঘটতে থাকবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এর জন্য মৌলিক জায়গা চিহ্নিত হবে করে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বের করতে হবে।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় জামির হোসেন নামের এক বাসচালকের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় দুই দিন পরিবহন ধর্মঘট চলার পর সোমবার প্রশাসনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা এলেও পরে শ্রমিক নেতারা কর্মসূচি বহাল রাখার কথা বলেন।

এর মধ্যে ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার আদালতে ট্রাকচালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় হলে রাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কর্মসূচি দেয়।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুই চালকের সাজার প্রতিবাদে সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া শ্রমিকদের ধর্মঘট নিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

শাজাহান খানকে উদ্দেশ করে ফেসবুকে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর রক্তের দাগ আপনার হাতে এক সময় ছিল মাননীয় মন্ত্রী। আমরা সবাই ভুলে যাচ্ছিলাম। আপনি আবার শেখ হাসিনার শান্তির দেশে অবরোধ ডেকে মনে করিয়ে দিলেন আপনার অতীত।’

ছাত্রলীগের সহসভাপতি আহসান হাবিব তার ফেসবুকের পাতায় লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার হাতে দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন দালাল শ্রেণির শ্রমিকনেতারা দেশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ব্যস্ত। ওই সব দালাল শ্রমিকনেতাদের বলছি, দেশের পরিবেশ খারাপ করবেন না।’

শাজাহান খানকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক রফিকুল ইসলাম। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘শাজাহান খানকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হোক। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হোক। তাহলে বাংলাদেশে এ ধরনের অবৈধ আন্দোলন ও ধর্মঘট বন্ধ হবে।’

মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব অযৌক্তিক ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত।’

ধর্মঘট আহ্বানকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আদালত এ রায় দিয়েছেন, জনগণ দেয়নি। রায়ের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে জনগণ কেন কষ্ট পাবে?’

এ ছাড়া ‘রায়ের প্রেক্ষাপটে ধর্মঘট দুঃখজনক’ উল্লেখ করে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘যারা ধর্মঘট করছেন তাদের উদ্দেশে আমি কেবল এইটুকু বলতে চাই, আপনাদের যদি কোনো বক্তব্য থাকে, আপনারা যদি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে আদালতের সামনে আপনাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন। আইনে সেই বিধান আছে। জনগণকে কষ্ট না দিয়ে বক্তব্য থাকলে সেটা স্পষ্ট করেন, যদি সেটা যুক্তিসঙ্গত হয়, তাহলে আমি বলতে পারি, এটা দেখা হবে। কিন্তু যদি অযৌক্তিক হয়, তাহলে এটা দেখা হবে না’

কিন্তু তাদের এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছিল পরিবহন শ্রমিকরা। এমনকি এ নিয়ে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর গাবতলীতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে একাধিক ব্যক্তি (তিন পুলিশ সদস্যসহ) আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে, এর রেশ ধরে বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক বাসচালকের মৃত্যুও হয়েছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের শ্রম-বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘মন্ত্রী (শাজাহান খান) ও প্রতিমন্ত্রী (মশিউর রহমান রাঙ্গা) সম্পর্কে যে সব কথা উঠেছে তা উঠতেই পারে। মালিক ও শ্রমিক একসঙ্গে কাজ করে। প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা মালিক সমিতির সভাপতি এবং মন্ত্রী শাজাহান খান শ্রমিক ফেডারশেনর কার্যকরি সভাপতি। এর মানে একজন প্রেসিডেন্ট, একজন সেক্রেটারি। উনাদের সংগঠনের পক্ষে থেকে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এটা হতেই পারে। সর্বশেষ যেটা জানলাম-মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও খন্দকার এনায়েতউল্লাহ সাহেব বৈঠক করেই এ ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। তাহলে তারা যদি ধর্মঘট না ডেকে থাকেন, তারা প্রত্যাহার করলেন কিভাবে? অন্যেরা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা (ধর্মঘট) করে থাকেন, তাহলে তো তাদের (মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর) কথা শোনার কথা না।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রিপরিষদে সদস্য থেকে দাবি আদায়ের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা, এটা কাম্য নয়। আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা যদি লঙ্ঘন হয়ে থাকে, তাহলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তা সমাধান করা যেত। একজন মন্ত্রী ধর্মঘট ঘোষণা করবেন, এটা চলতে পারে না।’

বুধবার দুপুরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যে রায়টি হয়েছে, সেটির বিচারের ব্যাপারে তারা চাইলে উচ্চ আদালতে যেতে পারে। কিন্তু তারা শুরুতেই জনহানিকর কাজে লিপ্ত হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকরা অহেতুক ধমর্ঘট পালন করছে। তাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে, আশা করি, সমস্যার সমাধান হবে। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। আইনি প্রক্রিয়া ছিল, তারা সে পথে যেতে পারতেন।’

শ্রমিক ধর্মঘট প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘বিভিন্ন সময়ে দেখা যাওয়া স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে সরকারের সফলতা নষ্ট হচ্ছে। উন্নয়ন কাজ চলছে, এসব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটা খেয়াল রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘জনজীবনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে, সেখানে (পরিবহন ধর্মঘটে) একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বের অভিযোগ উঠেছে। এবং উনার নেতৃত্বেই আবার আপোস হলো। এখন কথা হচ্ছে, মৌলিক বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, আজকে ঠিক হয়ে গেল, কিন্তু এটা যে আবার ঘটবে না তার নিশ্চয়তা নেই। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।’

(দ্য রিপোর্ট/এমএইচ/জেডটি/এনআই/মার্চ ০১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর