thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

‘এখন বুঝতে পেরেছি, জয়নুল কেন পাকিস্তানে চলে যাননি’

২০১৭ মার্চ ১৪ ২৩:৫৭:১২
‘এখন বুঝতে পেরেছি, জয়নুল কেন পাকিস্তানে চলে যাননি’

জয়নুল আবেদিন একজন সাংবাদিক, একজন উর্দুভাষী বাংলাদেশি, একজন অতিমানব। জন্মসূত্রে তিনি উর্দুভাষী হয়েও ছিলেন বাংলাদেশি। পাসপোর্টে তার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লেখা ছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের ঠিকানা, ১৮/তোপখানা। বাস্তবতা মেনে চললে তার ঠিকানা হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে, নিজের পরিবার পরিজনদের সাথে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রেমে, বাংলাদেশের রূপে তিনি এতটাই মজে ছিলেন যে, আপন শিকড়, ডাল-পালা বাদ দিয়ে শেষমেশ পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে। একজন উর্দুভাষী হয়েও বাংলাভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করেছেন রাজপথে। বাংলা ভাষার সমর্থনে উর্দুতে ব্যানার পোস্টার লিখে ঢাকায় বসবাসরত উর্দুভাষীদেরকে বুঝিয়েছেন বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য, তাদের সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন। গলা ফাটিয়ে বলেছেন, ‘হামার জবান, বাংলা জবান’।

জয়নুল আবেদিন আর সব উর্দুভাষী বিহারীদের মতো হননি। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় শাসকগোষ্ঠীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। বরং ১৯৫২ সালে যেমন তারা বাংলা ভাষার জন্য গলা ফাটিয়েছেন, রাজপথ কাঁপিযেছেন তেমনি, ১৯৭১ সালে নির্যাতিত বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছেন।

যে মানুষটা উর্দুভাষী হয়েও বাংলা ভাষাকে, ভিনদেশি হয়েও বাংলাদেশকে ভালবেসে, পরিবার পরিজন ছেড়ে এ দেশেই সারাটা জীবন উৎসর্গ করলেন, জীবদ্দশায় গুটি কয়েক লোক বাদে তার খোঁজ কেউ নেয়নি। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ভুলে গিয়েছিল অতীত। তাই তার মৃত্যুতে কোনো শোকবার্তা দেননি কেউ।

অকৃতদার এই মানুষটির একমাত্র আশ্রয় বলতে ছিল জাতীয় প্রেসক্লাব। প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। প্রেসক্লাবেই থাকতেন। অন্য সদস্যদের জন্য প্রেসক্লাব দ্বিতীয় আবাস হিসেবে পরিগণিত হলেও তার কাছে প্রেসক্লাবই ছিল প্রথম আবাস। এমনকি তার পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লেখা ছিল ১৮/তোপখানা(প্রেসক্লাব)। ভাষা আন্দোলনে অবদান স্বরূপ একমাত্র প্রেসক্লাবই তাকে জানিয়েছিল সম্মান, ২০১৪ সালে। প্রাপ্তি বলতে ওইটুকুই। এভাবে চলতে চলতে হয়ত একসময় অভিমান জন্মে জয়নুলের মনে। শেষে হয়ত ওই অভিমান সাথে নিয়েই গত ৯ মার্চ বাংলাদেশপ্রেমী জয়নুল আবেদিন পাড়ি জমান না ফেরার দেশে, নিঃশব্দে।

তার সম্পর্কে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ তার ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তিনি অবাঙ্গালী হয়েও বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। পরিবারেরসবাইপাকিস্তানেচলেগেলেওতিনি বাংলায় থেকে গেছেন বাংলারটানে, একা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় এ কর্মী উর্দুতে দেয়াল লিখন ও বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক উক্তি ও স্লোগান লিখে ঢাকায় বসবাসরত উর্দুভাষীদের বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করেছিলেন।’

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। পাকিস্তান সরকার তা টের পেয়ে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করে। জাতীয় প্রেসক্লাবে সদ্য আবিষ্কৃত স্যুভেনিয়রে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখা যায়।মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু তার সাথে সরাসরি কথা বলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে নাগরিত্ব চান এবং পাকিস্তানে থাকা তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে নাগরিকত্ব দেন এবং পাসপোর্টের ব্যবস্থা করেন।

জয়নুল আবেদিন ১৯৩৭সালেতৎকালীনব্রিটিশভারতেরউত্তরপ্রদেশেরএলাহাবাদেএকসম্ভান্তমুসলিমপরিবারেজন্মগ্রহণকরেন।মুহাম্মদগোলাম মোস্তফাও মা জয়তুন বেগমের চার পুত্রকন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা একজন ধর্মীয় পন্ডিত ছিলেন। মহররম মাসে জন্মেছিলেন বলে বাবা তার নাম রেখেছিলেন জয়নুল আবেদিন। বাবা ইস্টইন্ডিয়ানরেলওয়ের হেড ড্রাফটসম্যানহিসেবেকর্মরতছিলেন বিধায় তার শৈশবকেটেছেবিহারে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তার বাবা পূর্বপাকিস্তানরেলওয়েতেযোগদেন।নতুনকর্মস্থলহয়সৈয়দপুরে।

মেট্রিকুলেশনপড়ার সময়ই মাকে হারান জয়নুল। বাবা অধিকাংশ সময় কাজে থাকায় ছোট ভাইদের দায়িত্ব নিতে হয় নিজ কাঁধে। স্কুলে থাকা অবস্থাতেই জয়নুল তখনকার গোপনকমিউনিস্টপার্টিতেজড়িয়ে পড়েন। পরে ঢাকায় এসে ঢাকাকলেজথেকেআইকমও জগন্নাথ থেকে বি কমএবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। এরপর ১৯৫৭সালেউর্দু দৈনিক‘জং’ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে তার।পরেবাংলাদেশের বেশ কিছু জনপ্রিয় দৈনিক যেমন,মর্নিংনিউজ,বাংলাদেশটাইমস,চিত্রালী,ওয়াতন ও সংবাদসংস্থাএনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেকাজকরেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘জং’এরবাংলাদেশপ্রতিনিধিহিসেবেকাজকরেছেন তিনি।

জয়নুল আবেদিন অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষ ছিলেন বলে জানিয়েছেন জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ঠজন, হলিডে পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ও রেডিও তেহরানের বাংলাদেশ প্রতিনিধি আব্দুর রহমান খান। জয়নুল আবেদিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জয়নুল আবেদিন আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো ছিলেন। ক্ষোভের কারণেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, সারাজীবন বিয়ে করেননি তিনি। পরিবারের অন্যরা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে কোনো আত্মীয়-স্বজন ছিল না তার। আমার পরিবারকে তিনি নিজের পরিবার বলে মনে করতেন। খেতে ভালবাসতেন। হাজির বিরিয়ানী খুব পছন্দ করতেন। আমি তার কাছ থেকে উর্দু গজলের অর্থ বুঝে নিতাম আর মীর্জা গালিবের গজল,বাহাদুর শাহের গজলসহ ক্লাসিকাল গজলের তালিম নিতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গজলের রেকর্ড বাজাতেন। আর এসব গজলের গুঢ় অর্থ আমাদের কাছে তুলে ধরতেন। অসাধারণ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশকে, বাংলা ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। তিনি বাংলাদেশকে নিজের মাতৃভূমি বলে মনে করতেন। জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন ভাল বন্ধুকে হারালো আর আমরা হারালাম একজন আপনজনকে’।

জয়নুল আবেদিনের জানাজায় অংশগ্রহণের আগমুহূর্তে তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বাংলাদেশকে ততটা ভালবাসতে পারিনি যতটা জয়নুল আবেদিন পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে নিজের দেশ হিসেবে মনে করতেন। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি দেশ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। যা আমাদের অনেকেই হতে পারিনি।’

লাশ সামনে রেখে জানাজার পূর্বমুহূর্তে জয়নুল আবেদিনের আরেক বন্ধু আমানুল্লাহ বললেন, ‘জয়নুল এতো ভালো মানুষ ছিলেন যে আমার মনে হয় সে ছিল মহামানব।’

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মুরসালিন নোমানী দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘তার সাথে আমার বেশি দিন মেশার সুযোগ হয়নি । জাতীয় প্রেসক্লাবের লাউঞ্জে ঢুকতেই বাম পাশের কোনায় আর সার্বক্ষণিক চেয়ারে বসে থাকতে দেখবো না। প্রচার বিমুখ ও নিভৃতচারী এই মানুষটির সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। অবাঙালী এই ভাষা সৈনিকের স্মৃতি রক্ষার্থে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।’

বাংলাদেশের অকৃত্রিম এই বন্ধু গত বছর ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা বাড়লে চলতি বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লিভারে সমস্যা ধরা পড়লে ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে লিভার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। যে তারিখে বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষা করার দাবিতে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- সেই ২১ তারিখেই তিনি চিরতরে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বেশ কয়েকদিন এ অবস্থায় থেকে গত ৯মার্চ সহকর্মীদেরকাছে‘ঝনুভাই’নামেপরিচিত জয়নুল আবেদিন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। শুক্রবার(১০মার্চ) মিরপুরেবুদ্ধিজীবীকবরস্থানে তাকেদাফনকরা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

সোমবার (১৩মার্চ) বাদ আছর জাতীয় প্রেসক্লাবে তার স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ অনুষ্ঠানে দৈনিক সমকালের সম্পাদক ও জয়নাল আবেদিনের বন্ধু গোলাম সারওয়ার, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহানসহ প্রেসক্লাবের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা জয়নুল আবেদিনের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। পরে ঢাকা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে জয়নুল আবেদিনের পরিবারের কাছে একটি শোকবার্তা পাঠানো হয়।

মাহফিলে গোলাম সারওয়ার বলেন, জয়নুল আবেদিন তাদেরই একজন,যারা ভৌগোলিক সীমারেখা ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি আমার ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমি একজন বন্ধুকে হারিয়েছি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই সিরাজউদ্দিন। ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরই তিনি পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেন। মিলাদ মাহফিলে সংক্ষিপ্ত কথামালায় তিনি বলেন, আমি এখন বুঝতে পেরেছি, জয়নুল আবেদিন কেন এই প্রেসক্লাব,এই দেশে ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান নি।

মঙ্গলবার (১৪মার্চ) কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের উদ্যোগে ঢাকা ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভায় জয়নুল আবেদিনের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।

আগামী শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি জয়নুল আবেদিন স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করবে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মহান এই বন্ধুকে সম্মান জানানো হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি । জীবদ্দশায় দেওয়া হয়নি কোন সুবিধা। অসুস্থ থাকাকালীন চিকিৎসার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হলেও সেখান থেকে কোন সাড়া আসেনি। এ নিয়ে জয়নুল আবেদিন সামান্য অভিমান করলেও আক্ষেপ করেননি কখনো্। বারবারই বলেছেন, ‘যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য জীবন দেয় সে দেশেরমানুষের সাথে আছি, চলতে পারছিএটাইতো অনেক। এটা তো ভাগ্যের ব্যাপার’। দ্য রিপোর্টকে এই কথা জানিয়েছেন সাংবাদিক আব্দুর রহমান খান, যিনি তার মৃত্যুর আগের তিন-চার বছর সবসময় ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/জেডটি/এনআই/মার্চ ১৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর