thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার জট

এক বছরে নিষ্পত্তির তিনগুণ মামলা হাইকোর্টে

২০১৭ মার্চ ১৫ ২২:১০:৪৭
এক বছরে নিষ্পত্তির তিনগুণ মামলা হাইকোর্টে

হাইকোর্ট বিভাগে বাড়ছে ডেথ রেফারেন্স মামলার জট। গত বছর (২০১৬ সালে) হাইকোর্টে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, দায়ের হয়েছে তার চেয়েও তিনগুণ। এ অবস্থায় কনডেম সেলে থাকা আসামিদের দিন কাটাতে হচ্ছে এক অজানা আশঙ্কার মধ্যে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ আইনে অনুমোদিত যে কোনো দণ্ড দিতে পারেন; তবে এই রূপ কোনো জজ মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করলে তা হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে।’

ফলে দায়রা আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়। আইনের এই বিধানটিই ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে পরিচিত।

একজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর তাকে আলাদা সেলে রাখা হয়। যেটি কনডেম সেল হিসেবে পরিচিত। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর আসামি আপিল না করলে হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্তের পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই দিনাতিপাত করতে হয়। হাইকোর্ট বিভাগে কেউ খালাস পেলেও সেই রায় পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে এসব আসামিকে সেসময় পর্যন্ত কারাবরণ করতে হয়।

এতে একদিকে যেমন দোষী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রাপ্তি বিলম্বিত হয়, তেমনি দোষ প্রমাণ না হলে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকেও দীর্ঘ সময় কারাবরণ করতে হয়।

ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অনেকেরই এই দণ্ড হাইকোর্টে এসে বহাল থাকে না। অনেকে আবার খালাস পান আপিল বিভাগ থেকেও। তাই দায়রা আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে খালাস পেলেও তার জীবন থেকে বড় একটা সময় পার হয়ে যায় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই।

বিগত বছরে চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি মামলায় দেখা যায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামিই ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে খালাস পেয়েছেন। ২০০৪ সালে গাজীপুরের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনা ঘটে। এই মামলায় ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক আদালত ২৮ আসামির ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন।

ঘটনার এক যুগ পর ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ জুন হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে মাত্র ছয় জনের। পূর্বের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে খালাস পেয়েছেন সাতজন। আর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে আরও সাতজনকে। বাকি দুজন আপিল চলাকালে মারা গেছেন।

২০০০ সালে কলেজছাত্রী বুশরা হত্যার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় হওয়া মামলায় ২০০৩ সালে বিচারিক আদালত তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে ২০০৭ সালে হাইকোর্ট একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছিলেন এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। পরে গত বছর ১৫ নভেম্বর আপিল বিভাগ থেকে সব আসামিই খালাস পান।

ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী শাজনীন তাসনিম রহমান ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালত ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শেষে ২০০৬ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্ট পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, খালাস পান একজন। আপিল শুনানি শেষে এই মামলায় ২০১৬ সালের ২ আগস্ট একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের খালাস দেন আপিল বিভাগ।

এভাবে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বহু আসামি ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে হাইকোর্ট থেকে খালাস বা লঘুদণ্ড পেয়েছেন। তাই ডেথ রেফারেন্স শুনানি যতই বিলম্বিত হয়, ততই ভুক্তভোগী ও আসামি উভয়পক্ষের উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পায়।

হাইকোর্টে বর্তমানে রাজধানী পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় একটি স্পেশাল বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হচ্ছে। তাই অন্য মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে কিছুটা চাপ পড়ছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও হাইকোর্টের আরও তিনটি ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগের বছরগুলোর তুলনায় গত বছরে ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির হার কমেছে। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ৪৮ ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অপরদিকে মামলা দায়ের হয়েছে ১৬১টি।

তাই ৪১১টি অনিষ্পন্ন মামলা নিয়ে বছর শুরু হলেও বছর শেষে ডেথ রেফারেন্স মামলা সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২৪টি। মামলা বৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জট আরও বাড়বে বলে আশঙ্ক প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কনডেম সেলে থাকা প্রতীক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে দিন দিন।

সুপ্রিম কোর্টের চেষ্টা সত্ত্বেও চলতি বছর এই নিষ্পেত্তির হার বাড়া নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘বিডিআর এর মামলা নিয়ে একটি বেঞ্চ ব্যস্ত থাকা, বিচারক স্বল্পতা, পেপার বুক তৈরিতে বিলম্ব, নিজস্ব প্রেস না থাকা ও জনবলের ঘাটতির কারণে মামলা জট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধান করা না গেলে মামলা নিষ্পত্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়াটা কঠিন।’

ডেথ রেফারেন্স মামলা জট বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘মানুষ বাড়লে অপরাধ বাড়বে, তাতে মামলা বাড়াটাও স্বাভাবিক। তবে মামলা বৃদ্ধির তুলনায় উচ্চ আদালতে বিচারক বাড়েনি। তাই মামলা জটও বাড়ছে।’

তবে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডের পরিমাণ বাড়াকেও এজন্য দায় দিচ্ছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘তথ্য-প্রমাণ যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে সতর্কতার সঙ্গে ফাঁসির আদেশ দেওয়া উচিত। একজনকে হত্যার জন্য দেখা যায় এখন ১০ জনের ফাঁসি হচ্ছে। এগুলোর দণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে আসে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে উচ্চ আদালতে বিচারক সংখ্যাও খুবই কম। তাই মামলা জট বাড়ছে। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বছরের পর বছর কনডেম সেলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এ জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সতর্ক হওয়া উচিত।’

এদিকে মামলা বৃদ্ধি পাওয়াটাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ডেথ রেফারেন্সে মামলা জট বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো দায় আছে বলেও মনে করেন না তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই একই অবস্থা। স্বাভাবিক নিয়মই নিষ্পত্তির তুলনায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বেশি হয়। আর ডেথ রেফারেন্স তো অনেক সেন্সেটিভ মামলা। কাউকে তো আর কচুকাটা করা যাবে না।’

এখতিয়ারসম্পন্ন বেঞ্চ সংখ্যা বাড়ালে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির হার বাড়বে কিনা, জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘বেঞ্চ বৃদ্ধির বিষয়টা তো প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার। এ ছাড়া শুধু বেঞ্চ বাড়ালেই তো হবে না, দক্ষ বিচারপতিও তো লাগবে।’

দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো করণীয় রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ তার কাজ যথা নিয়মেই করে যাচ্ছে।’

ডেথ রেফারেন্স মামলার এই চাপ বৃদ্ধির কারণে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হচ্ছে। যার মধ্যে সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার শুনানি শেষে রায়ের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। খুলনার শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান দম্পতি হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্সও শুনানির জন্য তালিকায় রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করা হয়েছে বিশ্বজিত হত্যা মামলাতেও। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরি হচ্ছে।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/এনআই/মার্চ ১৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর