thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

দুধ-ডিম-মাংস উৎপাদনে ঘাটতি, বেড়েই চলছে দাম

২০১৭ মার্চ ২৩ ২২:২১:০৩
দুধ-ডিম-মাংস উৎপাদনে ঘাটতি, বেড়েই চলছে দাম

দেশে দুধ, ডিম ও মাংসের সরবরাহে বড় ধরণের ঘাটতি রয়েছে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না উৎপাদন, তাই বেড়েই চলছে ডিম, দুধ ও মাংসের দাম। এতে করে দেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা মিটছে না। পুষ্টির যোগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ খাবারগুলো তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণিসম্পদের পোল্ট্রি খাতে যতটা বিকাশ হচ্ছে, পশুসম্পদের ক্ষেত্রে ততটা হয়নি। এজন্য ঘাটতি দূর হচ্ছে না। সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, আগের তুলনায় ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তবে চাহিদা বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। ঘাটতি পূরণে নানা ধরণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে নিত্যপণ্যের বাজারে যে জিনিসটির দাম সবেচেয়ে বেশি বেড়েছে তা হলো-গরু ও খাসির মাংস। ২০১৫ সালেও প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। সেখানে সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের ২৩ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, বাজারভেদে বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৪৬০-৫০০ টাকা। আর খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়।

দেশি মুরগির ডিম প্রতি হালি ৪০ থেকে ৪২ ও ফার্মের মুরগির ডিম ৩০ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুর্লভ হয়ে উঠেছে দেশি মুরগি। মাঝারি আকারের একটি দেশি মুরগি ৩৫০-৩৯০ টাকায় ‍বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬৫ টাকায়। তরল দুধের দাম কেজি প্রতি ৬০-৭০ টাকা।

দেশের দারিদ্রতা কমলেও পুষ্টির যোগান দেওয়া এ খাদ্যগুলোর দাম এখনও একটি বড় জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা রয়েছে। ডিমের চাহিদা বছরে ১০৪টি।

দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ ধরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, বছরে দেশে দুধের চাহিদা এক কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার টন। সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন। সেই হিসেবে একজন মানুষ দৈনিক চাহিদার অর্ধেক (১২৫ মিলিলিটার) দুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে বছরে দুধের উৎপাদনে ঘাটতি ৭৪ লাখ ১৬ হাজার টন।

বছরে ডিমের চাহিদা এক হাজার ৬৭৪ কোটি ৪০ লাখ পিস। এরমধ্যে উৎপাদন হয় এক হাজার ১৯১ কোটি ২৪ লাখ পিস। ঘাটতি ৪৮৩ কোটি ১৬ লাখ পিস। একজন মানুষ বছরে ১০৪টির পরিবর্তে ৭৫টি ডিম পাচ্ছে।

একজন মানুষের দৈনিক মাংসের চাহিদা অনুযায়ী দেশে বছরে ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টন মাংসের প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাংস উৎপাদিত হচ্ছে ৬১ লাখ ৫২ হাজার টন। মাংসের উৎপাদনে ঘাটতি ৯ লাখ টন।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ৩৬ শতাংশ এখনো খর্বকায়, শীর্ণকায় ১৪ শতাংশ শিশু। পাশাপাশি, অপুষ্টির কারণে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে ৩৩ শতাংশ শিশু।

আইসিডিডিআরবি ও ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উচ্চমাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের ৩৬টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ৫১ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় (অ্যানিমিয়া) ভুগছে। মায়েদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আইনুল হক দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। পশুর অধিক উৎপাদনশীল জাত তৈরি হচ্ছে। ৪৫ লিটার দুধ দেওয়া গাভীও এখানে তৈরি হয়েছে। ৪০০-৫০০ কেজি মাংস দেওয়া গরুও আমরা তৈরির চেষ্টা করছি।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘আগামীতে ডেইরি ও মাংসের জন্য বড় একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছি। গাভী পালনের জন্য ৫ শতাংশ হারে ঋণের ব্যবস্থা করেছি।’

মো. আইনুল হক আরও বলেছেন, ‘আমরা উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছি। প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পশু-পাখির রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।’

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১০ বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, দুধ, ডিম ও মাংসের ঘাটতির কারণ হলো এ সময়ে গবাদি পশু-পাখির সংখ্যা কাঙ্খিত হারে বাড়েনি।

২০০৬-০৭ অর্থবছরে মোট গবাদি পশু-পাখির সংখ্যা ছিল ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার। এ সময়ে ৮ কোটি ১৫ লাখ গবাদি পশু-পাখি বেড়েছে।

এরমধ্যে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার। গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজারে। হাঁস-মুরগীর সংখ্যা ২৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে হয়েছে ৩২ কোটি ৬ লাখ ৩৩ হাজার।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, ‘প্রাণিসম্পদ খাতে পশু পালনের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বিষয়টি বেশ দীর্ঘ মেয়াদী। সেজন্য পোল্ট্রির সঙ্গে তুলনা করলে এ খাতটি পিছিয়ে আছে। মাংস ও দুধের ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘গরুসহ গবাদি পশু পালনের জন্য চারণভূমিসহ জমি লাগে, কিন্তু আমাদের জমি সংকট দেখা দিয়েছে।’

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশনের মহাসচিব মঞ্জুর মোর্শেদ খান দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘বেসরকারিভাবে বিনিয়োগের জন্য পোল্ট্রি খাত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যদিও উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশ কম, তারপরও মানুষ কিনতে পারছে। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, ২০২১ সালে তার দ্বিগুণ দরকার হবে। ওই লক্ষ্যেই পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি কাজ করছে।’

তবে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বেসরকারি বিনিয়োগের গতি খুব কম জানিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে গোখাদ্যের অভাব এবং গবাদিপশুর রোগ-প্রতিরোধের ওষুধের পর্যাপ্ততার ঘাটতি আছে। দামি গরুর নিরাত্তার জন্য ভাল ওষুধপত্র নেই। এজন্য ওইদিকে বিনিয়োগ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।’

মঞ্জুর মোর্শেদ আরও বলেছেন, ‘উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় ক্রেতাদের একটু বেশি দাম দিতে হচ্ছে এটা ঠিক। তবে দাম না পেলে কেউ বিনিয়োগেও তো উৎসাহিত হবে না।’

জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদের অবদান ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যদিও ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ হার ছিল ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। অপরদিকে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২১ শতাংশ।

ধীরে ধীরে বাড়ছে দুধের উৎপাদন

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, দুধের উৎপাদন ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ২২ লাখ ৮০ হাজার টন। পরের বছর ছিল ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। কিন্তু এরপরের দু’বছর উৎপাদন আবার কমে যায়। ২০০৮-০৯ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২ লাখ ৯০ হাজার ও ২৩ লাখ ৭০ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়।

এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে দুধের উৎপাদন যথাক্রমে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন, ৫০ লাখ ৭০ হাজার টন, ৬০ লাথ ৯২ হাজার টন ও ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টন।

৯ বছরের মাংস উৎপাদনের চিত্র

২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ ৪০ হাজার টন। এরপরের বছর উৎপাদন ৪০ হাজার টন বাড়ে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ১২ লাখ ৬০ হাজার টন। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরে দুধের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টন, ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন, ৩৬ লাখ ২০ হাজার টন, ৪৫ লাখ ২১ হাজার ও ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টন।

ডিমের উৎপাদন

২০০৬-০৭ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ৫৩৬ কোটি ৯৬ লাখ। পরের বছর ডিম উৎপাদিত হয় ৫৬৫ কোটি ৩২ লাখ। কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থবছরে উৎপাদন কমে হয় ৪৬৯ কোটি ৬১ লাখ। ডিমের উৎপাদন ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫৭৪ কোটি ২৪ লাখ, ২০১০-১১ বছরে ৬০৭ কোটি ৮৫ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৩০ কোটি ৩৮ লাখ পিস।

২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭৬১ কোটি ৭৪ লাখ, ২০১৩-১৪ বছরে এক হাজার ১৬ কোটি ৮০ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৯৯ কোটি ৫২ লাখ পিস ডিম উৎপাদিত হয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/জেডটি/মার্চ ২৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর