thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

বাহা উৎসবে সাঁওতালদের বসন্তবরণ

২০১৭ মার্চ ২৫ ২০:৩৯:১৩
বাহা উৎসবে সাঁওতালদের বসন্তবরণ

মো. আব্দুর রাজ্জাক, দিনাজপুর : বসন্ত ঋতু এলেই গাছে গাছে নতুন ফুল মানুষের দৃষ্টি কারে। শিমুল, পলাশের শোভায় প্রকৃতি নিজেকে নতুন রূপে প্রকাশ করে। আদিবাসী সাঁওতালরাও বসন্তকে বরণ করে নেয় তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বাহা উৎসব দিয়ে।

বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) ও শুক্রবার (২৪ মার্চ) জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও বাহা উৎসব উদযাপন কমিটি এবং আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদের আয়োজনে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার আদিবাসী পল্লীর বারকোনা ফুটবল মাঠে দুই দিনব্যাপী ‘বাহা উৎসব ১৪২৩’ উদযাপন করা হয়।

এ সময় সাঁওতাল তরুণীরা নতুন নতুন ফুল তাদের খোঁপায় গেঁথে আনন্দে নাচে-গানে মেতে ওঠে। তাদের গ্রামে গ্রামে চলে আনন্দ উৎসব এবং বাড়িতে তৈরি করে হাঁড়িয়া। সবাই হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দে বিভোর হয়ে মাদলের তালে তালে গাইতে থাকে, নাচতে থাকে। আর সেই আনন্দ-উৎসবের নাম ‘বাহা উৎসব।’

উত্তরাঞ্চলে সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে উড়াও, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়ী, রাজওয়ারসীসহ মোট ৩৮টি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী এই বাহা উৎসব পালন করে থাকে।

দিনভর ধর্মীয় পুজা-অর্চনা ও ভারতের জনপ্রিয় সাঁওতাল ও বাউল লোকসঙ্গীতশিল্পী রথীন কিস্কুর মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দুইদিনব্যাপী বাহা উৎসব পালন করেন উত্তারঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ ও সাঁওতাল আদিবাসীরা। এ সময় বিভিন্ন বর্ণের আদিবাসীদের আগমনে মিলনমেলায় পরিণত হয় বারকোনার ফুটবল মাঠ।

বাহা পরব ফাল্গুণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয়ে থাকে। গ্রামের মানঝি (গ্রাম প্রধান) পরবের দিন ঠিক করে। বাহা পরবের জন্য নির্দিষ্ট একটি পূজার স্থান থাকে। একে সাঁওতালরা জাহের থান বলে। তিনটি ছোট ছোট খড়ের ঘর দিয়ে জাহের থান তৈরি করা হয়। গ্রামের নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত পরিষ্কার ধুতি পড়ে পূজা থানে যান। নাইকের হাতে কাঁসার থালাতে থাকে নতুন ফুল। এ সময় সাঁওতাল তিন দেবতা জাহের এঁরা (ফুলের দেবী), মারাঙবুরু (সাঁওতাল দেবতা প্রধান), পারগানা বঙ্গার (এলাকার দেবতা) পূজা করেন।

গ্রামের নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত গণেশ বেসরা বলেন, সাঁওতালদের বেশ কয়েকজন দেবতা রয়েছে যাদের মধ্যে জাহের এঁরা, মারাঙবুরু, পারগানা বঙ্গা। এই দেবতারা বাড়িতে থাকে এবং বাড়ির বাইরে থেকেও ডিউটি দেয়। এজন্য এই দেবতাদেরকে আমরা এই মাসে নতুন শাল ফুল দিয়ে পুজা দেই। আর পুজা দেওয়ার পরেই আমরা নতুন ফুল, ফল ছিড়ি।

বাহা পুজার উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে যে, আমরা যেন আজ থেকে সারাবছর ভালাভাবে চলতে পারি। আমাদের যেন কোন অমঙ্গল না হয়, কষ্ট না হয়।এই আনন্দ যেন সারাবছর সবার সাথে একইরকম থাকে।

বাহা উৎসব সম্পর্কে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, আদিবাসী সাঁওতালদের অন্যতম একটি প্রধান পার্বণ হচ্ছে বাহা উৎসব বা বাহা পরব। এটি তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। বাহা অর্থ ফুল। তাই বাংলায় বাহা পরবকে ‘ফুল উৎসব’ বলা হয়। মূলত নববর্ষ হিসেবে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করে সমতলে বসবাসকারী সাঁওতালরা।

বাহা পরবের মূল কথা হচ্ছে এই পরব না করা পর্যন্ত সাঁওতাল মেয়েরা সারজম বাহা (শাল ফুল), ইচাক বাহা, মুরুপ বাহা এগুলো খোঁপায় দিতে পারেনা। এই পরবের মধ্য দিয়েই নতুন বছরের ফুল, ফল, পাতাকে সাঁওতাল আদিবাসীরা ব্যবহার করতে শুরু করে।

এ দেশের প্রকৃতির সাথে আদিবাসী সমাজ মিশে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, যেভাবে বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং আদিবাসীরা যেই জায়গা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী এসব সংস্কৃতি আগের সেই জৌলুস হারাতে চলেছে। আর সেই কারণে অনেক সাঁওতাল আদিবাসীরা এই উৎসব পালন করতে পারছে না। এভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি ধ্বংস হতে থাকলে আদিবাসীরাও একদিন হারিয়ে যাবে। তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে ও তাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতেই এই বাহা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

তাই আমরা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও জাতীয় নারী আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদ, যুব পরিষদসহ উত্তরবঙ্গের সংগঠন মিলে আমরা চেষ্টা করছি আদিবাসীদের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, পালা-পরব যাতে নষ্ট বা হারিয়ে না যায়। এই বাহা উৎসবের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই যে, সংস্কৃতি হচ্ছে আদিবাসীদের পরিচয়। প্রতিবছর যেন আমরা এই বাহা, সহরাই, আরও যেই যেই পরব আছে আদিবাসীদের সেগুলো যেন আমরা পালন করি এবং প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যেন এই উৎসব পালন করা হয়।

ভারতের জনপ্রিয় সাঁওতাল ও বাউল লোকসঙ্গীত শিল্পী রথীন কিস্কু বাহা উৎসব সম্পর্কে বলেন, খুব ভালো লাগছে বাংলাদেশে এসে। আমাদের সাওতালদের যে কৃষ্টি-কালচার, আমাদের প্রাচীন যে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এটা তুলে ধরেছেন এখানকার মানুষজন। যা আমরা ভারতবর্ষে পেয়ে থাকি। বাহা মানেই মানুষের মিলন, মানুষের যোগাযোগ, মানুষের মধ্যে একটি প্রেম, কৃষ্টি-কালচারকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা সেটা আমরা এই পার্বতীপুর উপজেলার বারকোনায় দেখতে পেয়েছি। আমি চাই প্রত্যেক বছর যেন এই উৎসব উদযাপন হয় আর এপার বাংলা-ওপার বাংলার মিলন মেলা তৈরি হয়।

স্থানীয় যোসেফ হেমব্রম বলেন, আমার দাদার এবং জ্যাঠার কাছ থেকে শুনেছি আমরা নাকি আদিকালে বনে বাস করতাম। বনই নাকি ছিল আমাদের জীবন। বনই আমাদেরকে লালন করতো। বনের অনেক গাছ থেকে খাদ্য সৃষ্টি হতো। সেই গাছকে দেবতা মনে করে আর জীবনকে যেন রক্ষা করে সেই জন্যই আমরা বাহা উৎসব করি।

শিক্ষার্থী রমিতা হাসদা ও সোহাগী সরেন বলেন, আমরা শাড়ি পরে নৃত্য পরিবেশন করতে এসেছি। আর আমরা চাই নৃত্য দিয়েই যেন এই বাহা উৎসবটি ভালোভাবে পালিত হয়। পরে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীদের পাশাপাশি ভারতের জনপ্রিয় সাঁওতাল ও বাউল লোকসঙ্গীত শিল্পী রথীন কিস্কুর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি দল সঙ্গীত পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন।

এরআগে বাহা উৎসবের প্রথম দিন (বৃহস্পতিবার) দুপুর ৩টায় উৎসব উদ্বোধন করেন উদযাপন কমিটির আহবায়ক বাসন্তি মুরমু। বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, সাধারণ সম্পাদক শফিন চন্দ্র মুন্ডাসহ আরও অনেকে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএনইউ/এপি/মার্চ ২৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর