thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণের চার বছরে ৯ জনের মৃত্যু

‘সোয়া দুই শ' পথচারী মারা যাওয়ার কথা ছিল’

২০১৭ মার্চ ৩১ ২৩:১৫:৪৯
‘সোয়া দুই শ' পথচারী মারা যাওয়ার কথা ছিল’

রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি। নির্দিষ্ট সময়ে তা শেষ করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা। এদিকে, নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকেই প্রকল্প এলাকায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় শ্রমিকসহ এ পর্যন্ত ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। সর্বশেষ চলতি বছর ১২ মার্চ মালিবাগ রেলগেটে গার্ডার পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দু’জন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তমা কনস্ট্রাকশনেরব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মূল প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপেরচেয়ারম্যান এবং নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘ফ্লাইওভার নির্মাণে শ্রমিক ও পথচারীদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই প্রকল্পের ৯০-৯৫ শতাংশ কাজ শেষ করছি কি করে? তাহলে তো (নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে) সোয়া দুইশত পথচারী মারা যাওয়ার কথা ছিল।’

ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ এ বলা হয়েছে, কোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় নির্মাণ এলাকা এবং এর চারপাশে যথোপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাস্তা বা জনসাধারণের চলাচলের স্থানে নির্মাণকাজ করা হলে সেখানে অস্থায়ী ঘের, জীবন রক্ষাকারী বাধা এবং বিকল্প চলাচল পথ তৈরি করে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বিধিমালায়। কিন্তু, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় এসবের অনেক কিছুই অনুপস্থিত বলে সরেজমিনে দেখা গেছে।

দেখা গেছে, মালিবাগ মোড়ে লোহার খুঁটি দিয়ে ফ্লাইওভারের ঢালাই কাজের আয়োজন করা হয়েছে। নিচের সড়কটি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এই সংকীর্ণ অংশ দিয়ে এলোপাতাড়ি যানবাহন চলাচল করছে। যান নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানে কেউ নেই।

এ বিষয়ে মোতালেব হোসেন নামে এক পথচারী বলেন, ‘গার্ডার স্থাপনের সময় বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি উপরে তোলা হচ্ছে আবার নামানো হচ্ছে। এর কোনো অংশ যদিনিচে পড়ে তাহলে নিচ দিয়ে চলাচলকারী মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত।’

রাসেল নামের এক রিক্সা চালক জানান, এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত তিনি বা অন্য রিকশাচালকরা যাত্রী নিয়ে যেতে চান না। কারণ, চলাচলের সময় সারক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়; এই বুঝি মাথার উপর কিছু পড়ল।//////////

চলতি মাসের ১২ মার্চ গভীর রাতে মালিবাগ রেলগেটে ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে নিহত হন স্বপন নামে এক নির্মাণ শ্রমিক। আহত হন তমা কনস্ট্রাকশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পলাশ বরণ ধর ও শাহ সিমেন্টের লরি চালক নূর নবী। পলাশের বাঁ পা এবং নূর নবীর ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পলাশ বর্তমানে ভারতের চেন্নাইয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এর আগে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল উড়াল সড়কের মগবাজার প্রান্তে নির্মাণ কাজ চলার সময় প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মাজেদ মন্ডল ও আসাদুল মন্ডল নামের দুই সহদোর শ্রমিক নিহত হন। দুর্ঘটনার পর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন কর্তৃপক্ষ জানায়, নিহত দুই শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

গত বছরের ১৬ মার্চ মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের মৌচাক মার্কেটের কাছে নির্মাণ যান্ত্রপাতির আঘাতে রাব্বী আহমেদ ইমন (২২) নামে এক শ্রমিক প্রাণ হারান। এরপর একই বছর ২৫ মার্চ দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিতের আদেশ দেয় উচ্চ আদালত। গত বছরের ১৬ জুন প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে সুমন নামের আরেক শ্রমিক মারা যান। এর বাইরেও ছোটখাটো অনেক দুর্ঘটনার সংবাদ রয়েছে।

এত দুর্ঘটনার পরও শ্রমিক এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আতাউর রহমান ভূঁইয়া বলেছেন, ‘শ্রমিকের নিরাপত্তা কন্ট্রাক্টরের চাইতে অন্য মানুষ বেশি চিন্তা করে নাকি? শ্রমিক ও পথচারীর নিরাপত্তাব্যবস্থা চিন্তা করেই আমরা কাজ করছি।’

কিছুদিন আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে, নির্মাণ কাজ এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, ঝুঁকি নিয়েই নিচ দিয়ে মানুষ ও গাড়ি চলাচল করছে, এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘গাড়িটা বন্ধ করে দেন না দয়া করে! এক মাস গাড়ি বন্ধ থাক, আমরা ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ করে ফেলি? পারবেন বন্ধ করতে? পারবেন না। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কত টাকা কমপেনসেশন (ক্ষতিপূরণ) দেওয়া লাগতেছে।’

তমা কনস্ট্রাকশনের এমডি আরও বলেছেন, ‘এই যে সাধারণ মানুষের জন্য সরকার এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প করতেছে, এত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এই প্রকল্পটা হচ্ছে, আপনারা বলেন না যে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটা শেষ হলে এলাকার লোকের কত উপকার হবে। আমরা ঝুঁকি মাথায় নিয়া নিজের শ্রমিক, নিজের ইঞ্জিনিয়ার, নিজের গাড়ি-ঘোড়া সব কিছু রিক্স এর (ঝুঁকির মধ্যে) মধ্যে রেখে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ করেছি। এর মধ্যে একটা মানুষ মারা গেছে। প্রতিদিন রাস্তায় শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, কউ আপনারা তো রাস্তার মাঝখানে বেরিয়ার দিয়ে বন্ধ করতে পারলেন না? বলতে পারেন না যে রাস্তার মাঝখানে বেরিয়ার দিয়া দেন, তাহলে এতো দুর্ঘটনা ঘটবে না!’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আপনারা যেমন সাংবাদিক, সারাদিন আমার এগেইনেস্টে (বিরুদ্ধে) লিখতেছেন, এটা আপনার অধিকার। তেমনি এ দেশের নাগরিক হিসেবে দুই-চারটি কথা বলা আমার অধিকার। প্রতিদিন রাস্তায় ১২ থেকে ১৪ জন করে মানুষ মারা যায়। আর এখানে এতো বড় একটি প্রকল্প করতেছি, একটা এক্সিডেন্টে একজন শ্রমিক মারা গেছে, এইজন্য টকশো… টকশো ওয়ালাদের নামায়ে দেন না যে ভাই আসেন এই প্রজেক্টটা করে দিয়ে যান, যাতে একটা লোকও মারা না যায়। প্রত্যেক রাস্তার মাঝখানে বেরিয়ার দিয়ে দেন না! তাহলে তো এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে না।’

আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমার কষ্ট লাগে...এত ঝুঁকি নিয়া আমরা প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ শেষ করেছি; এজন্য সাংবাদিক ভাইয়েরা সরকারকেও ধন্যবাদ দেয় না, কন্ট্রাক্টরকেও ধন্যবাদ দেয় না। তা না, গার্ডার কেন পড়ে গেল…কন্ট্রাক্টর ঠেলে ফেলে দিয়া (গার্ডার) মানুষ মেরে ফেলেছে? এটাই শুধু ইস্যু। আর কোনো ইস্যু নাই? এটাই আমাদের কষ্ট।’

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, ‘নির্মাণ আইনে কিছু ক্রটি থাকায় কাজের সময় হতাহতের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হচ্ছে না। এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনাকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে না দেখলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। আর নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিষয়টিও তারা (নির্মাণকারীরা) গুরুত্ব দেবে না।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এনআই/মার্চ ৩১, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর