thereport24.com
ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল 24, ১১ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৫ শাওয়াল 1445

বন্যার পানিতে বিলীন হাওড়ের সোনালী স্বপ্ন

২০১৭ এপ্রিল ০৯ ২২:০৯:৩১
বন্যার পানিতে বিলীন হাওড়ের সোনালী স্বপ্ন

সেলিম আহমেদ, মৌলভীবাজার : বুক ভরা রঙিন স্বপ্ন, আশা আর নানা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড়, হাইল হাওড়, সোনাদিঘি, কাওয়াদিঘির হাওড় ও কইরকোনা বিলে চাষ করেছিলেন কৃষকরা। চৈত্রের আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে কৃষকের সোনার ফসল। হাওড়ের সর্বত্র এখন থৈ থৈ করছে পানি আর পানি। পানিতে পচে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের স্বপ্নের সোনার ফসল।

কৃষকদের অতিকষ্টে ফলানো ধানের উপর দিয়ে এখন চলছে নৌকা। জেলার সর্বত্র বিরাজ করছে হাহাকার। ৬ মাসের ঘামঝরা পরিশ্রমের ফলানো বোরো ধানের একমুঠও ঘরে আনতে পারেননি এ জেলার কোন কৃষক। গত দুই বছরই আগামবন্যায় জেলার হাওড়গুলোর বোরো ধান নষ্ট করেছিল, কোন কৃষক ঘরে তুলতে পারেননি স্বপ্নের ফসল। পর পর তিন বছর বোরো ধান তুলতে না পারায় কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে হাহাকার। এবার হাওর তীরের গ্রামগুলোতে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার কাঞ্জার হাওর, মানিক হাওড়, হাইল হাওড় ও কাউয়াদিঘি হাওর পানির নিছে তলিয়ে গিয়ে ৬২২ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওড়ের ৩০৭ হেক্টর, রাজনগর উপজেলার সোনাদিঘি, কাইয়াদিঘি ও সিঙ্গাহুরা হাওরের ১৩৬৬ হেক্টর, কমলগঞ্জ উপজেলার কেওলার হাওরের ৩০০ হেক্টর, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওড়, ডলডল হাওড়, রফিনগর হাওড়, খাদিমপাড়া হাওড়, আলিয়ার হাওড়, বহিষমারা বলি, মেঘাবিল, হাওর বিল, কালাপানির বিল, পালের বিল, হাগুয়া বিল ও লাউয়র বিলসহ অন্যান্য বিলের ৪৫০০ হেক্টর, বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওড়, মালাম বিল ও হুয়ালা বলির ৩৪১৫ হেক্টর, জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওড় ও কইরকোনা বিলের ৪৬৫০ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়াও হাকালুকি হাওড় পাড়ের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৯-১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

বিশেষ করে হাকালুকি হাওরপাড়ের কৃষকরা নতুন ধান ঘরে তোলার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ধান কাটার উপযোগী না হওয়ায় কেউই ঘরে নতুন ধান তুলতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই তিন উপজেলার বেশিরভাগ কৃষক বিভিন্ন ব্যাংক, সমিতি ও ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ এনে জমি চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু ধান পানির নিছে তলিয়ে যাওয়া কীভাবে মানুষের ঋণ পরিশোধ করবেন আবার কীভাবে সংসার চালাবেন এনিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

হাকালুকি হাওড় পারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এবছর ফলন ভালো হাওয়ায় কৃষকেরা স্বপ্ন দেখছিলেন বাম্পার ফলন ঘরে তুলবেন। কিন্তু ধান পাকার পূর্বেই হঠাৎ করে টানা ৭-৮ দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে চোখের সামইে তাদের স্বপ্ন তলিয়ে যায়। ধানের শীষ বের হওয়ার পর গত বুধবার থেকে ভারি বর্ষণ ও থেমে থেমে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। চৈত্র মাসের অকাল বৃষ্টিতে হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্ন বন্যার পানিতে মিশে যায়। ইতোমধ্যে টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরে বন্যার পানি টইটুম্বুর হয়ে হাওড়ের প্রায় সবটুকুই বোরো ধান তলিয়ে গেছে। কোন কৃষই দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফসল ধান ঘরে তুলতে পারেননি। গত দুই বছরই আগাম বন্যায় হাকালুকির বোরো ধান নষ্ট হয়েছিল। পর পর দুই বার বোরো ধান তুলতে না পারায় কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে হাহাকার ও হতাশা। পর পর তিন বছর বোরো ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়ায় হাওর তীরে এবার তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কাকা রয়েছে।

সরেজমিনে হাকালুকির পাড়ের কুলাউড়ার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ভুকশিমইল, জাব্বা, কুরবানপুর, শাহাপুর, গৌড়করণ, মুক্তাজিপুর এলাকার ঘুরে দেখা গেছে- থোড় বের হওয়ার পূর্ব অবস্থায় বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ভুকশিমইল গ্রামের ইউপি সদস্য ফখরুল ইসলাম, সাবেক ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন সাঈদ, জিয়াউর রহমান মিন্টু, নজরুল ইসলাম জানান, আর মাত্র ১৪-১৫ দিনের মধ্যে ফসল কাটা শুরু হতো। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে চোখের সামনেই আমাদের স্বপ্নের সলিল সমাধি হলো।

বড়লেখা উপজেলার হাওড়পাড়ের পতুনগর, নিজবাহাদুরপুর, কানকাইড়ছক, দশঘর এলাকার কৃষক আখলু মিয়া, হাছন আলী, ফরিদ আলী, সুলেমান মিয়া ও আকল মিয়া জানান, হাওড় পাড়ের প্রতিটি মানুষই কৃষির উপর নির্ভরশীল। পর পর তিন বছর থেকে আমরা বোরো ধান ঘরে তুলতে পারিনি। সরকার যদি আমাদের দিকে এ বছর সুনজর না দেয় তাহলে হাওড় তীরে দুর্ভিক্ষ লাগার সম্ভাবনা রয়েছে।

জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওড়পাড়ের শাহাপুর, রাজাপুর, বেলাগাঁও এলাকার কৃষক রমুজ মিয়া, আবিদ মিয়া, মন্তর আলী, পাখি মিয়া বলেন, অনেক কৃষক টাকা সুদ আবার অনেকে ব্যাংক থেকে লোন করে কিংবা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ধার করে চাষ করেছি। এ বছর ধান পেলাম না এখন কি করে সে ক্ষতি পূরণ করবো সেটা চিন্তা করতে পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে হাওড় বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও ও কৃষি বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপ হলে তারা বলেন, ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারী নদী খনন না করার কারণে হাকালুকি হাওড়ের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। যার ফলে দু-একদিনের বৃষ্টির কারণে পুরো হাওড়টি তলিয়ে যায়। তাদের দাবি এ অঞ্চলের কৃষকদের বাঁচাতে হলে যতদ্রুত সম্ভব ওই খালটি খনন করে পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকতা মো. কুতুব উদ্দিন বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার বোরো চাষীদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি।

কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জগলুল হায়দার বলেন, পানিতে ধান ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এটি প্রাকৃতিক সমস্যা। এতে কিছু করার নেই।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো. গোলাম রাবিব জানান, আমরা হাওড়পাড়ের এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। এলাকার সার্বিকচিত্র খুবই ভয়াবহ। ধানতো নাই, ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের বাড়িঘর, স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এখন আবার বন্যায়ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। কৃষি ও পিআইও অফিস মিলিয়ে কুলাউড়া উপজেলায় অকাল বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত নিরূপণের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান তথ্যটি নিশ্চিত করে বলেন, হাওড়গুলোর প্রায় ৯৫% বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকদের ধান ঘরে তোলার সম্ভাবনা এখন আর খুব একটা নেই।

(দ্য রিপোর্ট/এপি/এনআই/এপ্রিল ০৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর