thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ 24, ১৫ চৈত্র ১৪৩০,  ১৯ রমজান 1445

ড. জামাল নজরুল ইসলাম

২০১৪ ফেব্রুয়ারি ২৪ ০৩:০১:৫০
ড. জামাল নজরুল ইসলাম

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত।

জামাল নজরুল ইসলামের বাবা ছিলেন ঝিনাইদহ শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য)। তার বয়স যখন এক বছর তখন তিনি কলকাতায় বদলি হন। জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিশু বিদ্যাপীঠে পড়েন। তারপর আবার মডেল স্কুলে ফিরে যান। এরপর চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান। সেখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন। ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর সেখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০), প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি (১৯৬৪) এবং এসসিডি বা ডক্টর অফ সায়েন্স (১৯৮২) ডিগ্রি অর্জন করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি যে সব বিষয় নিয়ে কাজ করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিদ্যা, কনফরমাল মহাকর্ষ তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ ও মহাজাগতিক ধ্রুবক। পশ্চিমের সেরা বিজ্ঞানীদের কাছে পড়া ছাড়াও তিনি স্টিফেন হকিং ও প্রফেসর আব্দুস সালামের মতো খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফের (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সের গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালে গণিতের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ক্লাসের পড়ার অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। যা পরবর্তীতে তার অনেক কাজে লাগে। উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই গণিত নিয়েছিলেন। কম্পিউটার ও ক্যালকুলেটরের বদলে গাণিতিক হিসাব মাথা খাঁটিয়ে করতে পছন্দ করেন। ২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংসের গুজব রটলে তিনি গণিতের হিসাব কষে দেখান, সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বই পড়তে ভালোবাসেন। শখ ছিল গান শোনা ও ছবি আঁকা। রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল সবচেয়ে প্রিয়। এ ছাড়া চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছেন এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন।

তার লেখা বই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। ‘দ্য আলটিমেট ফেইট অফ দ্য ইউনিভার্স’ (১৯৮৩) কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলা বইটি জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ ভাষায় অনুদিত হয়। ডব্লিউ বি বনোর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’ (১৯৮৪)। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ (১৯৮৫), ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’ (১৯৯২), ‘কৃষ্ণ বিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’, ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত) এবং ‘দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স’।

তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক (১৯৮৫), ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল (১৯৯৪), ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানের মেডাল লেকচার পদক (১৯৯৮), কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক (২০০০), একুশে পদক (২০০১) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক (২০১১)। এ ছাড়া বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য ছিলেন।

১৯৬০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি সুরাইয়া ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই মেয়ে- সাদাফ সাজ সিদ্দিকি ও নার্গিস ইসলাম।

ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগজনিত সমস্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ মার্চ ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে মারা যান।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/জেএম/এএল/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

SMS Alert

এই দিনে এর সর্বশেষ খবর

এই দিনে - এর সব খবর