thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বন্যাদুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি

হাকালুকি হাওরে চলছে হাহাকার

২০১৭ এপ্রিল ১৯ ২৩:০১:৩১
হাকালুকি হাওরে চলছে হাহাকার

সেলিম আহমেদ, মৌলভীবাজার : ভাই, আমরা কোন্ পাপ করেছি, আল্লাহ আমরার উপর এ কি গজব ঢাললা। আখতা পানি আইয়া আমরার সারা ধান খাইলাইলো। তও মনরে শান্তি দিছলাম, মনে করলাম চাইরটা মাছ মারিয়া বাজারও বেচিয়া খাইমু কিন্তু তাও অইলো না।...ঘরে ভাত নাই, আওর মাছ নাই কিলা বাল বাচ্চা পালতাম। সরকার তনেও আমরারে এখন পর্যন্ত কোন কিচ্ছু দেওয়া ওয় নাই। সরকার যদি আমরারে কোন সাহায্য করে তাইলে কিলা চলেমু। আমরার মাঝে আকাল দেখা দিব।

দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন হাকালুকি হাওর পাড়ের সাদিরপুর গ্রামের বাসিন্দা ও টলার বেড় বিলের পাহারাদার মৎস্যজীবী হান্নান উদ্দিন।

এ চিত্র শুধু হান্নানের পরিবারের নয়, হাওর পাড়ের দুই জেলার ৫ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ বাসিন্দার। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মানুষের মাঝে বিরাজ করছে হাহাকার। কীভাবে দিনাতিপাত করবেন ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। হাওর পারের মানুষের এত ক্ষতি হওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি কোন ত্রাণসামগ্রী। ফসলহারা এ পাঁচ উপজেলাকে এখন পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি বন্যাদুর্গত এলাকা। সরকার যদি সুনজর না দেয় তাহলে হাওর তীরে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী।

সরেজমিন হাওর তীরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, এ বছর চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা অঞ্চল এবং সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা অঞ্চলের ছোটবড় ২ শতাধিক বিলের পারে প্রায় ২৫ সহস্রাধিক হেক্টরে এবার বোরো ধানের আবাদ করা হয়। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানে তেমন রোগ বালাই দেখা না দেওয়ায় ফলনও ভাল হয়। শতকরা ৩৫ ভাগ ফুল আসা অবস্থায় ও ৬৫ ভাগ ফুল আসার পূর্ব অবস্থায় গত বুধবার থেকে ভারি বর্ষণ ও থেমে থেমে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওরে পতিত জুড়ী নদী, কন্ঠিনালা, ধলাইছড়া, মাধবছড়া, ধামাইছড়া ও সোনাই নদীতে পানি বাড়তে থাকে। এতে ২৫ সহস্রাধিক হেক্টর জমির বোরো ধানের পাশাপাশি হাকালুকি হাওরের ছোটবড় ২৩৭টি বিলও তলিয়ে যায়। জলমহালগুলো নির্দিষ্ট সময়ের আগে হাওরময় ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে অকালবন্যায় তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে। ধান ক্ষেতে ঘাস নিধনের বিষের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও পানিতে তলিয় থেকে ধানগাছে পচন ধরে। হঠাৎ পানির পিএইচ কমে যাওয়ায় অক্সিজেন হ্রাস পেয়ে গণহারে মারা গেছে মাছ। সেই মরা মাছ খেয়ে মারা যাচ্ছে হাওর পাড়ের মানুষের পালিত হাঁস।

কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, মাছ মরার কারণ হলো অকাল বন্যায় তলিয়ে যাওয়া আধাপাকা ধান ও ধানগাছ পচে পানির গুণাগুণ নষ্ট করেছে। হঠাৎ পানির পিএইচ কমে যাওয়ায় অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং দ্রবীভূত অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় করণীয় হলো- হাওরে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ করা (জেলেদের প্রণোদনা দিয়ে হলেও), পানির ট্রিটমেন্ট করা (যদিও তা অনেক ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য)।

হাওরের টলারবেড় বিল, কালা পানির বিল, ফুট বিল, আওরানা বিল, রইবি বিল, লাগুয়া বিল ঘুরে দেখা যায়, হাওরে প্রচুর মরা মাছ ভাসছে। ভেসে ওঠা মরা মাছের মধ্যে পুঁটি, টেংরা, ভেদা, বাইলা, বোয়াল, চান্দা, পাবদা ও রুই জাতীয় মাছের ছোট পোনা মরে ভেসে উঠছে। তলিয়ে যাওয়া ধান ও পচা মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে হাওরজুড়ে। এছাড়াও পুরো হাওরের পানির উপর তেলের মতো একটি আবরণ তৈরি হয়েছে। জেলে ও স্থানীয়দের ধারণা মরা মাছে তেলের আবরণ এগুলো।

হাকালুকি হাওর তীরের ভাটেরা ইউনিয়নের নোমান আহমদ, নজরুল ইসলাম বেলাল, সৈয়দ টিপু জানান, হাওর থেকে যখন বাতাস আসে তখন দুর্গন্ধে যেন নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে বমি আসে। মাছ আর ধান পচে একাকার। দুর্গন্ধে এলাকায় বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

হাওরের কালা পানির বিলে কথা হয় জেলে সজ্জাত আলী ও আব্দুল মোহাইমিন ফাহিমের সাথে। তারা জানান, এবার যেভাবে মাছ মরের এভাবে আর কোন দিন দেখছি না। বিগত দিনে এমন সময় ভাসান পানি থেকে মাছ মেরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালানো সম্ভব হয়েছে। এবছর ধান পাইনি ঘরে ভাত নাই। হাওরে মাছ নাই কীভাবে সংসার চালাবো ভেবে পাচ্ছি না।

হাওর তীরের বাসিন্দা মৎস্যজীবী কবির আহমদ জানান, হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এখানে ২-৪ বছরের ব্যবধানে পাহাড়ি ঢলে অকালবন্যা হয়। কিন্তু এবারের মত চৈত্র মাসে কখনও বন্যা হয়নি। এই অকালবন্যায় ধানের পচনে মাছেও মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটিতে মৎস্য প্রজনন হুমকির মুখে পড়বে। সংকট সৃষ্টি হবে মাছেও। এমনিতে নেই ধান আর সেই সাথে যদি মাছও না থাকে তাহলে হাওর তীরের মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

হাকালুকি পাড়ের বাসিন্দা কৃষক আবুল হোসেন, মলিক মিয়া ও সবু মিয়ারা বলেন, পানিতে ধান নিয়েছে। অভাবের সংসার হাঁসের ডিম বিক্রি করে চালাতেন। হাঁস মরে যাওয়ায় একটি এনজিও থেকে তোলা ঋণ কীভাবে শোধ করবেন এ নিয়ে চিন্তিত তারা। হাকালুকি হাওর পাড়ের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার আশিঘর গ্রামের মাইজভাগ এলাকার বাসিন্দা কাদিম শাহ বলেন, খামারিরা হাওরে হাঁস ছাড়লে মাছ ও পোকা খেয়ে একের পর এক হাঁস মারা যায়।

কৃষি ক্ষেতের পাশাপাশি এনজিও থেকে উত্তোলিত ঋণের টাকায় হাঁস কিনে ডিম বিক্রি করে সংসার চালানোর আশা করেছিলেন হাওরবাসী। এনজিও থেকে তোলা সেই ঋণ এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে।

কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ জানান, এই অবস্থা এক ধরনের দুর্যোগ। হাকালুকি হাওরের মাছ মরা বন্ধে সাময়িক মাছ ধরা বন্ধে মাইকিং করা হয়েছে। হাওরে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চুন প্রয়োগ করা হচ্ছে। হাওর সংলগ্ন এলাকায় জনসচেতনতার জন্য মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় লোকজনের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।

(দ্য রিপোর্ট/এপি/এনআই/এপ্রিল ১৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর