thereport24.com
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল 24, ৩ বৈশাখ ১৪৩১,  ৭ শাওয়াল 1445

মামলার সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি

সেই ভয়াল দিনের চতুর্থ বর্ষপূর্তি সোমবার

২০১৭ এপ্রিল ২৩ ২৩:৫২:৩৯
সেই ভয়াল দিনের চতুর্থ বর্ষপূর্তি সোমবার

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, সময় সকাল পৌনে ৯টা। সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ঢাকা-উত্তরাঞ্চল মহাসড়ক সংলগ্ন রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবণ ধসে পড়লো বিকট শব্দে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই ভবনে সেদিন কাজ করছিলেন কয়েকটি পোশাক কারখানার প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক। মুহূর্তের মধ্যেই সেদিন ৯তলা ওই ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে। শত শত শ্রমিক চাপা পড়েন সেই ধ্বংসস্তূপের নীচে।

সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া এ মর্মান্তিক ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হন। পঙ্গুত্ববরণসহ আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। এখনো নিখোঁজ অনেকে, যাদের লাশও পায়নি স্বজনরা। নিহত শতাধিক শ্রমিকের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের উদাহরণ হয়ে থাকা সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে সোমবার (২৪ এপ্রিল)। এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলাসহ মোট ৩টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি। আর একটিতে অভিযোগ গঠনের আদেশের জন্য আগামী ৮ মে দিন ধার্য রয়েছে।

হত্যা মামলা

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়া রানা প্লাজা ভবনের নিচে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক চাপা পড়েন। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকর্মীরা। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে প্রায় আড়াই হাজার জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এতে আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। এ ঘটনায় সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি। আগামী ৭ মে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবণ নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওই দিন সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১৩০ জনকে।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এ মামলায় এখন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। মামলাটিতে ১৭ মে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

এ দুই মামলায় উল্লেখ্যযোগ্য আসামি হলেন-রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, রানার বাবা আব্দুল খালেক, রানার মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম এপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।

দুদকের দুর্নীতির মামলা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই প্রশাসনের অন্যান্য দফতরের মতো দুদকও নড়েচড়ে বসে। ঘটনার পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে কমিশন। ভবনটি সোহেল রানার বাবার নামে হওয়ায় ওই সময় মূল অভিযুক্ত সোহেল রানাকে বাদ দিয়ে তার বাবা-মা সহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। তদন্তে সোহেল রানাই ভবনের মূল দেখভালকারী ছিল তা প্রমাণ হলে চার্জশিটে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম ওই বছরের ১৬ জুলাই সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় চার্জশিট দাখিল করেন। এ মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষে ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান গত বছরের ৬ মার্চ দুদকের দেওয়া এ অভিযোগপত্রে ত্রুটি থাকায় পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে চলতি বছরের শুরুতে ফের একই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে দুদক।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ এম আতোয়ার রহমানের আদালতে অভিযোগ গঠনের আদেশের জন্য আগামী ৮ মে দিন ধার্য রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৪২.০২ শতাংশ শ্রমিক এখনো বেকার

শনিবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘অবিস্মরণীয় অমার্জনীয় : রানা প্লাজা’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা একশনএইড-এর এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে এখনো ৪২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার রয়েছে। বেকারত্বের মূল কারণ হিসেবে ৪৮ শতাংশের শারীরিক ও ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১৪০৩ আহত শ্রমিক ও ৬০৭ জন মৃত শ্রমিকের পরিবারের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করে একশনএইড।

রানা প্লাজার ঘটনা জাতির জন্য লজ্জা জনক

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বছর উপলক্ষে রবিবার (২৩ এপ্রিল) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক যৌথ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়ে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটিকে জাতির জন্য লজ্জাজনক হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনার চার বছর পার হলেও এ নিয়ে কোনো ধরনের পর্যালোচনা হয়নি। সংসদীয় কোনো কমিটিও গঠন করা হয়নি। রানা প্লাজার ঘটনার ফলে দেশে-বিদেশে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণে শীর্ষ পর্যায়ে একটি কমিটি থাকা উচিত ছিল, তাও হয়নি।’

একই অনুষ্ঠানে শ্রম সচিব মিকাইল সিপার বলেছেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। গার্মেন্ট সেক্টরের উন্নয়নে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকসহ এ খাতে কর্মজীবীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে সরকার।’

‘ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে বাস্তব ভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া উচিত’

রবিবার ব্র্যাক সেন্টারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বছর পূর্তিতে আলোচনা সভার আয়োজন করে ব্র্যাক। এতে আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেছেন,সাভারের রানা প্লাজায় সংঘটিত দেশের ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনার চার বছর পার হচ্ছে। কিন্তু নিহতদের পরিবার ও আহতরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছেন। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের গঠিত কমিটির সুপারিশও ‘আইনি সুরাহা’ না হওয়ায় বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিসহ সকল শিল্প দুর্ঘটনার শিকার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে বিকল্প ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।

তারা বলেছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও আহতদের সুষ্ঠু ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রয়োজন। এ নীতিমালা প্রণয়নে করণীয় ও সুপারিশসমূহ তুলে ধরতে ব্র্যাক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।

ব্র্যাকের ভাইস চেয়ারপারসন ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন শ্রম ও কর্মসংস্থানের যুগ্ম সচিব খন্দকার মোস্তান হোসেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার উল্লাহ এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ ও রানা প্লাজা ক্লেইমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সিনিয়র ক্লেইমস পর্যবেক্ষক ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাওসার।

‘নিছক দুর্ঘটনা ছিল না’

ব্র্যাকের এই আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেছেন, ‘২০১৩ সালের ২৪ মে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। এটা ছিল মানুষ সৃষ্ট দুর্ঘটনা। ভবন মালিক ও গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের লোভ ও উদাসীনতার ফলে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ঘটনা ঘটেছে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দুর্ঘটনার আগের দিন রানা প্লাজার ভবন থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের কাগজপত্র ও সরঞ্জমাদি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ওই দিন শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকতে চাননি। কিন্তু কর্মে যোগদান না করলে চাকরি থাকবে না, বেতন আটকে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। নিরুপায় হয়ে কর্মীরা কাজে যোগ দেয়।’

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেছেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা আমাদের ঘুম ভাঙানোর কল ছিল। এটি না ঘটলে হয়তো গার্মেন্টস সেক্টরে বর্তমানে যে সংস্কার হচ্ছে তা হতো না।’

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেডটি/এনআই/এপ্রিল ২৪, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর