thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

মে দিবস : বদলায়নি শ্রমিকদের ভাগ্য

২০১৭ এপ্রিল ৩০ ২৩:৩৭:৩৩
মে দিবস : বদলায়নি শ্রমিকদের ভাগ্য

সারা বিশ্বের কত কি বদলে গেল, বদলায়নি শ্রমিকের হাতের সেই সনাতনী কাস্তে-হাতুড়ি আর জন্ম-জন্মান্তরের শ্রম শোষণ। বছর ঘুরে আবারো খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন সার্থকতার দিন মহান মে (১ মে) দিবস এসেছে। তবে আর দশ-পাঁচটা দিবসের মতো আপামর বাঙালির জীবনে এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই। থাকার কথাও নয়। এখানে মে দিবস আসে নেহাত ৩০ এপ্রিলের পরের দিন ১ মে, সেই হিসেবে।

অন্য বছরের মতো এবারও এই দিনটিতে খুব সকালেই অনেক শ্রমিক কাজে বের হবেন। পুরুষ, নারী অথবা শিশু যেই হোক না কেন, যে শ্রমিকটি অগণিত ঘণ্টা ধরে গাধার খাটুনি খেটে চলেছেন, খুব ভোরে উঠে যার দিন শুরু, তার জন্য কোনো আট ঘণ্টার মহান মে দিবস নেই। সে জানেও না আট ঘণ্টা মানে কত ঘণ্টা? আমরা আজ যে উন্নত বিশ্বটাকে দেখতে পাচ্ছি তা গড়ে উঠেছে শ্রমিকের পরিশ্রমে। শ্রমিকের শ্রম ও ঘাম পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কত শ্রমিকের কত যুগ-যুগান্তের পরিশ্রমের ফলে রচিত হয়েছে উন্নতি-অগ্রগতির সোপান, সে কথা কোথাও লেখা হয়নি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শ্রমিক শ্রম দিচ্ছে। তার বিনিময়ে জুটেছে দু’মুঠো খাবার, আর নাম মাত্র কিছু পারিশ্রমিক।

মানিকগঞ্জ সদর এলাকার একটি ইটভাটায় কাজ করেন জলিল মান্না। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। তিনি ইট ভাটায় ইট টানার কাজ করেন। কর্মক্ষেত্র মাতিয়ে রাখেন গানে গানে। ইট ভাটার শ্রমিকরা জলিল মান্নার খুব ভক্ত। কাজের সাথে গান হলে কাজ যেন আরও দ্রুত বেগে চলে। তিনি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, আর্থিক অনটন থাকায় তিন ছেলের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে পারেননি তিনি। বর্তমানে তারাও শ্রমিক। তবে একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া করানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সংসারের খরচ জোগাতে প্রতিনিয়তই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সারাদিন ইট টানার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

মান্নার স্ত্রী শেফালী দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘যে যতবেশি ইট টানতে পারে সে তত বেশি বাহবা পায়। আর এই প্রশংসার জন্যে আমগো অতিকষ্টে পাল্লা দিয়ে করতে হয় ইট টানার কাম। পরিশ্রমের থাইক্যা মজুরি অনেক কম। সূর্য উঠনের আগেই আমগো কামে লাগতে হয়। সকালে নাস্তা করণের লাইগ্যা পাই এক ঘণ্টা বিরতি। আবার দুপুরে ঘন্টা খানেক খাওনের বিরতি পাই। এমনে দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত চলে কাম। সারাদিনে তো মনে ওয় ১২-১৪ ঘন্টা কাম করিই।’

বাবা-মার সঙ্গে শিশু শ্রমিকরাও নোংরা ময়লা ঘেঁটে জীবনের সুকুমার শৈশব-কৈশরকে মাটি চাপা দিচ্ছে। শহরের বাইরে মায়ের সাথে ইট ভাঙছে যে শিশু-কিশোরটি তাদের কাছেও মে দিবস কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তারা জানে তাদের হাতে ধরা হাতুড়ি একটু বেসামাল হলেই অন্য হাতে পড়বে, পঙ্গু হয়ে যাবে চিরতরে। এই দেশে ঠিক কত লাখ শ্রমিক এবং সেই সব শ্রমিকের কত লাখ অপ্রাপ্ত বয়সের শিশু-কিশোর শ্রমিক তার কোনো সঠিক খতিয়ান কারো কাছে নেই।

ইট টানতে টানতে হাতে কড়া পড়ে যাওয়া মান্না-শেফালীর কিশোর সন্তান মো. আজিজ দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছে, তার বয়সী শ্রমিকরা সারাদিনে হাজার খানেক ইট টানতে পারে। আর প্রতি হাজার ইট টানার জন্য মজুরি পায় ১০০ টাকা। তাই বেশি উপার্জনের জন্য তাদের প্রতিযোগিতা করে ইট টানতে হয়। পোড়ানো একেকটি ইটের ওজন আড়াই কেজির মতো। তারা একবারে মাথায় নেয় ৬-৮টি করে ইট। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তারা মজুরি নিয়ে বাজার করে বাসায় চলে যায়। খেয়ে-দেয়ে ঘুম দেয় পরের দিনের ভোরের অপেক্ষায়; ফের কাজে যাওয়ার জন্য। তাই শ্রমিক দিবস তাদের জন্য কোনো তাৎপর্য বহন করে না।

সারাদিনের পরিশ্রমের পরও শ্রমিকদের আবার আছে মৃত্যু ঝুঁকি। এরপরও তারা কাজ করে শুধু বেঁচে থাকার জন্য। এই গ্রীষ্মের গনগনে রৌদ্রে গরম হাওয়ায় যখন কেউ ঘর থেকে অতি প্রয়োজন ছাড়া বের হতে চায় না, এমনই এক একটি দিনেও শ্রমজীবী মানুষকে কাজ করতে হয়। শ্রমিকরা শুধু জানে ১ মে মানে সরকারি একটি ছুটির দিন। এ ছুটির দিনটি শ্রমিকদেরই জন্য, কিন্তু শ্রমিকরা কাজ ছাড়া থাকলে তাদের পেট যে চলবে না।

পুরান ঢাকার রুপচাঁদ লেনে নতুন একটি দালানের ছাদ ঢালাই শেষে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে চা-বন রুটি খেতে বসেছেন নির্মাণ শ্রমিক আকতারুজ্জামান। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘দিনে কাজের বিনিময়ে নগদ যা পাই, তাই লইয়্যা যাই। দিন হিসাবে কাজ করি। বাড়ির মালিক তো আর কোনো দিন (মে দিবস) বুঝবো না। আর বুঝলে আমগোই ক্ষতি। একদিন বইয়্যা থাকলে ওই দিনডাই মাটি। কালও (মে দিবসে) কাম আছে।’

পল্টনের অন্য একটি ভবনে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিক নজরুল ইসলাম দুপুরে ভাত খেতে খেতে দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছেন, দালালের মাধ্যমে কাজ পেয়েছেন তিনি। দালালের সঙ্গে ভবনের মালিকের পাওনা নিয়ে কথা হয়েছে। তারা চুক্তি ভিত্তিক কাজ করে দিচ্ছে। তবে দালালের সঙ্গে ভবনের মালিকের কত টাকার চুক্তি হয়েছে তা শ্রমিকদের অজানা।

তিনি বলেছেন, ‘ছুটির দিন হইলে আরও সমস্যা, ইনকাম থাহে না। আর সব সময় কাজ পাওনও যায় না। কারণ কাম করণের মানুষ অনেক। এহন কাম পাইছি, এহন আর কোনো ছুটির দিন বুঝি না। এহন কাম বুঝি। সরকার যদি এই দিনে বহায়া টাহা দিত তাইল্যে চিন্তা করতাম।’

সারাদেশে রাস্তা-ঘাট পরিচ্ছন্ন রাখা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সারাদিনের ময়লা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা; সেখান থেকে ময়লার স্তুপ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের নিদির্ষ্ট স্থানে ফেলে আসার কাজগুলো যারা করেন, তারা হলেন পরিচ্ছন্ন কর্মী। তারা যদি একদিন তাদের কাজ বন্ধ রাখেন তাহলে শহরের হাল যেমন হবে তাতে করে দুর্গন্ধে কেউ ঘরে থাকতে অথবা বাইরে বের হতে পারবেন কিনা সন্দেহ।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসা থেকে ময়লা এনে টিকাটুলির ডাস্টবিনে ফেলার কাজ করছিলেন লাভলী বেগম। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘মে-মু বুজি না। কাম করলে টাহা আহে। আর আমরা কাম না করলে এই সব বাসাত যারা থাহে তাগো নাকে হাত দিয়া চলতে হইবো। এমনি শরীরডা খারাপ থাকলে যদি একদিন না গেছি, তাইলেই বাসাগুলিত থিক্যা চিল্লা-চিল্লি করে। তহন মাস শেষে টাহা দিতেও কাপ-ঝাপ করে। আবার মে দিবস!’

রাজধানীর পল্টনে একটি বড় ডাস্টবিনের সামনে যে আবর্জনাগুলো বাইরে পড়ে গেছে সেগুলো আবার ঠিক মতো ডাস্টবিনে ফেলছিলেন লাইজু বেগম ও তার ছেলে রাশেদ। ডাস্টবিনগুলো ভরে গেছে, তাই নিচে পড়ে থাকা আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে তাদের অনেক সমস্যাই হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আবর্জনার উপর দাঁড়িয়েই তাদের এ কাজ করতে হচ্ছে। লাইজু বেগম দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘কাল (সোমবার, ১ মে) কাম করতে হইবো কিনা কইতে পারি না। আর এই কাম করতে করতে অভ্যাস হইয়া গেছে। কোনো দিন শরীর খারাপ থাকলে পোলাডা একলা আহে। ওর তহন ঝামেলা বেশি হয়। আমগো শহর পরিষ্কার করণের কাম, একদিন না আইলে কি পরিমাণ ময়লা যে জমে। আমগো কিআর নাগা (বন্ধ) আছে?’

প্রসঙ্গত, আগে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন পরিশ্রম করতে হতো। বিপরীতে মজুরি মিলত নগণ্য। শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করত, ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত। কিন্তু কারখানা মালিকরা তা মেনে নেয়নি। ১৮৮৬ সালের ১ মে ঘটনার দিন সন্ধ্যাবেলা হাল্কা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন। আগস্ট স্পিজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হন। পুলিশ তাৎক্ষণিক শ্রমিকদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে যা রায়টে (দাঙ্গা) রূপ নেয়। রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পিজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন ফাঁসির একদিন আগেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন এবং অন্য একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে স্পিজ বলেছিলেন, ‘আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।’

পরে ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার’ দাবি স্বীকৃতি পায়। আর ১ মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। পৃথিবীব্যাপী আজও তা পালিত হয়। বেশকিছু দেশে মে দিবসকে লেবার ডে (শ্রমিক দিবস) হিসেবে পালন করা হয়। এ দিনটি সরকারিভাবে ছুটির দিন। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় এ দিনটি পালিত হয় না।

ছবি : নীরব হোসেন মুকিত ও শামীম রিজভী

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/জেডটি/এনআই/এপ্রিল ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর