thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

‘এভাবে বিচার চললে অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো’

২০১৭ মে ০৯ ২৩:৫০:৫১
‘এভাবে বিচার চললে অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো’

সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের বিধান সম্বলিত সংবিধানের ষোড়ষ সংশোধনী বাতিলের আপিল শুনানিতে আদালতে দিনের (মঙ্গলবার) শুরু ও শেষে বেশ উত্তেজিত ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

শুনানি মুলতবি চেয়ে সময় আবেদন আদালত বিবেচনায় না নেওয়ায় আদালতে উত্তেজিত হয়ে যান তিনি। এক পর্যায়ে আপিল বিভাগের সব বিচারপতিকে নিয়ে আপিল শুনানি না করলে প্রধান বিচারপতির প্রতি অনাস্থার হুমকিও দেন তিনি।

ষোড়ষ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে আপিল শুনানি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে সোমবার (৮ মে) শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ মে) দ্বিতীয় দিনেও বেঞ্চে পাঁচ বিচারপতিই উপস্থিত ছিলেন।

বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। আপিল বিভাগে বর্তমানে সাতজন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এই মামলার শুনানিতে গত দুদিন ছিলেন না।

প্রায় দুই মাস বিরতির পর সোমবার এই মামলাটি কার্যতালিকায় আসে। এদিন শুনানির শুরুতেই একাধিকবার মুলতবির আবেদন করে সাড়া পাননি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শেষ পর্যন্ত ওইদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে মামলার শুনানি শুরু হয়।

এদিন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে হাইকোর্টের রায় পড়ার মাধ্যমে শুনানি শুরু করেন। বেলা সোয়া একটার দিকে রায় পড়া অসমাপ্ত অবস্থায় সোমবার প্রথম দিনের শুনানি শেষ হয়।

মঙ্গলবার দিনের শুরুতেই আপিল বিভাগ এই মামলার শুনানি শুরুর উদ্যোগ নেন। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দুইদফা সময় আবেদন করেন। সময় আবেদন নিয়ে আদালতের সঙ্গে তিনি বিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় তার।

এরপরও আদালত মামলা শুনানির সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর থেকে মাঝে আধঘণ্টা বিরতি বাদে হাইকোর্টের পুরো রায় পড়া শেষ করেন।

রায় পড়া শেষ হলে কয়দিনের জন্য মামলার শুনানি করা হবে তা নিয়ে দিনের শেষ বেলায়ও অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। শেষ পর্যন্ত ২১ মে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এই মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন আপিল বিভাগ।

মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল সাত বিচারপতির উপস্থিতিতে শুনানির আর্জি জানিয়ে সময় আবেদন করেন।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকবে, তা নির্ধারণ হওয়া দরকার।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি তো আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোনো শূন্যতা থাকা উচিত নয়।

তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা সাতজন। কিন্তু শুনছেন পাঁচজন। এভাবে বিচার চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো। তিনি আরো বলেন, আপনারা বলেছেন যে সবাই শুনবেন। আজ তা শুনছেন না। সাতজনকে শুনতে বলায় ভুল কোথায়?

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে হেয় প্রতিপন্ন (আন্ডার মাইন্ড) করছেন।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তা করছি না। আমাদের আবেদন, হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, বিতর্কিত কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখবো।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ে অনেক কথা আছে।

তখন বেঞ্চের অপর বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, এখনও তো মামলা শুনলামই না।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি শুনানি বিলম্ব করছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাদের আরেকটি আবেদন আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিচার বিভাগ (হাই কোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না। আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? গতকাল বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তাতো দেখছি না। আমরা তো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই।

প্রধান বিচারপতি বলেন, হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে সমস্যা কোথায়? আপনি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করুন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি বলেছিলেন যে সাতজনই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমিতো বলেছি মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলেতো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবো।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি পিড়াপিড়ি করছেন কেন?

এরপরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায় উপস্থাপন করবো। তবে আমাকে সময় দিতে হবে।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দফতরে একশ ৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। তাই এটা প্রস্তুত করতে এতো সময় লাগবে কেন?

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। এই সময় দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। আশা করছি এ সময়ের মধ্যে উনারা (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) ফিরে আসবেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন পাঁচজন শুনবেন বলেছেন তখন এটা বলেছি।

এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে সোমবার যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকে রায়ের বাকি অংশ পড়া শুরু করেন। বেলা একটার দিকে সেই রায় পড়া শেষ হয়।

এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ডায়াসে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা মাইনরিটি অংশ সমর্থন করেন কি না? উল্লেখ্য, হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের দুজন ষোড়ষ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। একজন বিচারক সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি সমর্থন করেছিলেন। ষোড়ষ সংশোধনী বৈধ বলে এক বিচারকের মতামতের উপর সমর্থন করার বিষয়ে জানতে চান আদালত।

এর জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও উত্তেজিত হয়ে যান। তিনি বলেন, এটা তো অবান্তর প্রশ্ন। আমরা তো মেজরিটির বিরুদ্ধে এসেছি। এখানে মাইনরিটির সমর্থন তো বিষয় নয়।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি অনেক চালাক।

এ সময় হেসে ফেলেন অ্যাটর্নি জেনারেলও। তিনি বলেন, তবুও ভাল, আমাকে ধুরন্ধর বলেননি।

বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, আপনি তো কালকে (শারীরিক অসুস্থতার কারণে সময় চাওয়া নিয়ে) অনেক অভিনয় করেছেন। আমরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা আশা করি আপনারা একটা রিটেন আর্গুমেন্ট (লিখিত যুক্তিতর্ক) দেবেন।

এ সময় আদালত এই মামলায় নিযুক্ত ১২ জন অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কাছে লিখিত মতামত চান।

তখনও অ্যাটর্নি জেনারেল বাগড়া দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা নিয়ে রাখলাম পরবর্তী শুনানি আসতে আসতে আমাদের পড়া হয়ে যাবে।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, গতকাল (সোমবার) সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান উপস্থিত ছিলেন। আজ ড. কামাল হোসেন, এমআই ফারুকী আছেন। আপনারা কি লিখিত মতামত এনেছেন?

জবাবে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন- আমি লিখিত মতামত দাখিল করেছি।

এ সময় আরেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে লিখিত মতামত আদালতে উপস্থাপন করেন।

এরপর আদালত শুরুতে ১৪ মে পরবর্তী দিন ধার্য করতে চান।

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপরাপর সকল মামলায় সকল পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। এ মামলায় সেটা করছেন না কেন। দুই সপ্তাহ সময় দেওয়ার আবেদন করছি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। ব্যবস্থাটা আপনাদের হোক আর আমাদরে হোক কাউকে নিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট এই সংবিধানের অভিবাবক। আমাদেরকে একদিকে যেতে হবে।

এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা মাঝামাঝিতে রাখলাম। আগামী ২১ মে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হলো। এ সময়ের মধ্যে অন্য আট অ্যামিকাস কিউরি ও রাষ্ট্রপক্ষ লিখিত বক্তব্য জমা দেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এই মামলার অপর আট অ্যামিকাস কিউরি হলেন- বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল এবং ব্যারিস্টার আজমালুল কিউসি।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও সাত বিচারপতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, করজোড়ে বলছি, সবাইকে নিয়ে শুনানি করুন।

তখন বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, এটা আপনার প্রার্থনা। আপনি তো বাধ্য করতে পারেন না।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না এটা আমাদের প্রার্থনা।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা চাই সবাইকে নিয়েই শুনতে। তবে একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকতে পারেন। একজন বিদেশে থাকতে পারেন। একজন তো জুলাইয়ে অবসরে যাবেন। কেউ জুলাই পর্যন্ত অসুস্থ থাকতে পারেন। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই প্রধান বিচারপতিকে আদালত চালাতে হয়।

এরপর আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।

শুনানি শেষে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সেখানে তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় আমরা দুটি দরখাস্ত দাখিল করেছি আদালতে। একটিতে বলেছি, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে হাই কোর্ট বিভাগ একটি জায়গায় বলেছেন, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। এখন সংসদ সদস্যদের মধ্যে কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এ তালিকা চাওয়া হোক। আদালত জবাবে বলেছেন এগুলো শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখবেন।

অপর দরখাস্তের বিষয়ে তিনি বলেন, আরেকটি দরখাস্ত করেছিলাম -দু’জন বিচারপতি বাইরে আছে, তাদেরসহ যাতে শুনানি করা হয়। এ বিষয়টির ওপর আমি আগা-গোড়াই জোর দিচ্ছি। যেহেতু এটা সাংবিধানিক ব্যাপার। সেহেতু আপিল বিভাগের সব ক’জন বিচারপতি যাতে শুনানিতে অংশ নেন।

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, আমি বলেছি সবাই যদি না শুনেন, সবাইকে যদি যুক্ত না করেন আমি হয়ত এ মামলা থেকে নিজকে প্রত্যাহার করার চিন্তাও করতে পারি। এর আগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সব বিচারপতিকে যুক্ত করেই এ মামলাটি শুনবেন। আজকে এক পর্যারয় উনি বললেন, না পাচঁজনই শুনবেন। তখন আমি বললাম সে ক্ষেত্রে আপনারা যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হবো।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/মে ০৯, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর