thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

নতুন ভ্যাট আইন

অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেট ভারীর সুযোগ বাড়বে

২০১৭ মে ১০ ২৩:১৩:২৮
অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেট ভারীর সুযোগ বাড়বে

মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ (যা নতুন ভ্যাট আইন নামে সমধিক পরিচিত); এতে এমন কিছু বিধান রয়েছে যেগুলোর অপব্যবহারের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আইনের অপব্যবহারের কারণে রাজস্ব কর্মকর্তাদের হয়রানির পরিমাণ বাড়বে এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আপোষ করতে হবে ব্যবসায়ীদের। এতে অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

নতুন আইনের সংজ্ঞায় ‘সহযোগী’ হিসেবে করদাতার আত্মীয়,অংশীদারী কারবারের অংশীদার, কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, ট্রাস্ট এবং ওই ট্রাস্টের সুবিধাভোগী, সম্পত্তি উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ এবং উদ্যোগের অংশীদার ভূমি মালিক, নির্মাতা বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ করদাতা ভ্যাট আইনের অধীনে দায়বদ্ধ থাকলে সহযোগী হিসেবে তার দায় ওই ব্যক্তিদের নিতে হবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সংজ্ঞার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট কর্মকর্তারা শুধু করদাতার আত্মীয় নন, তার সমগ্র ব্যবসা-বাণিজ্যের অংশীদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন। এতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হবেন এবং ব্যবসার পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।


তারা আরো বলছেন, করদাতার দায় তার আত্মীয়দের ওপর চাপানো কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। কোম্পানি আইনে শেয়ারহোল্ডারদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট আইনে অতিরিক্ত দায় চাপানো হয়েছে, যা অযৌক্তিক। ভ্যাট আইনের সংজ্ঞায় পরিবর্তন না আনলে অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নতুন আইনের ৮৩ ধারায় বলা আছে, কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে সহকারী কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্যবসা কেন্দ্র, অঙ্গন, ঘরবাড়ি, যানবাহনে প্রবেশ ও তল্লাশি করতে পারবেন। এ ছাড়া ব্যবসা কেন্দ্র পরিদর্শন করে তার রেকর্ডপত্র, নথিপত্র, দলিলাদি ও হিসাব পরীক্ষা করতে পারবেন। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি এই আইনে প্রণীত বিধির বিধান লঙ্ঘন করলে সহকারী কমিশনার বা তার ঊর্ধ্বের কর্মকর্তারা ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্য (ফ্রিজ) করতে পারবেন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হলে ব্যবসার সামগ্রিক কার্যক্রমে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে ব্যবসায়ীরা রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আপোষরফা করতে বাধ্য হবেন।

নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী, বছরে ৩০ লাখ টাকার কম লেনদেন(টার্নওভার) হয়, এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো ধরনের কর প্রদান করতে হবে না। কিন্তু ৩০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ও ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। আর টার্নওভার ৮০ লাখের ওপর হলে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

আগে সব প্রতিষ্ঠানকেই কর দিতে হতো। প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় ব্যবসায়ীরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতেন। ফলে এ নিয়ে বাড়তি কোনো ঝামেলায় পড়তে হতো না। কিন্তু নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট তুলে দেওয়ার কারণে হয়রানির নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের এ হিসাবটি মূল্যায়ন করবেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা। ফলে তারা টার্নওভারের যে পরিমাণ নির্ধারণ করে দিবেন সে অনুযায়ী কর দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন করে হয়রানির শিকার হবেন। এক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপোষরফা করতে হবে।

নতুন আইন অনুযায়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার খাতা, ট্রানজেকশনের হিসাব রাখাসহ অনলাইনে নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমাদের দেশে ব্যবসার পরিবেশ এখনও সে পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। আগে যেহেতু সাধারণ ব্যবসায়ীরা প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় ভ্যাট প্রদান করতো সেক্ষেত্রে এ ধরনের ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু ঠিকমতো ডকুমেন্টশন হয়নি-এমন অভিযোগ তুলে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘নতুন আইনের কিছু ধারা নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সুরাহা হয়নি। খেলাপীর জন্য আত্মীয়দের দায়বদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এ আত্মীয় কারা হবেন সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। করদাতার খেলাপীর জন্য তো তার স্ত্রী দায়বদ্ধ হতে পারেন না।’

বাংলাদেশ ইনডেনটিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এস সিদ্দিকী দ্য রিপোর্টকে বলেছেন, ‘নতুন ভ্যাট আইনে এমন সব বিধান রাখা হয়েছে সেগুলোর অপব্যবহার হবে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে ঘুষ দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। এতে রাজস্ব কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হবে।’

এ ছাড়া নতুন ভ্যাট আইনের ৮৩, ৯০, ৯১ ও ৯৯ ধারায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের সীমাহীন জুডিশিয়াল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এসব বিধানবলীর সংশোধন এবং কিছু বিষয়ে সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করার দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। তবে তাদের সে দাবি উপেক্ষিত হয়ে আসছে।

২০১২ সালে ভ্যাট আইন পাস হলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে আগামী অর্থ বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে এ আইনটি কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে এ আইনটি।

নতুন আইনে ভ্যাটযোগ্য সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় ক্ষমতা কমে যাবে এবং শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাবে। অপরদিকে, বর্তমানে এক হাজার ৫২০টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে এক শ্রেণির দেশীয় পণ্যকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করার ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এতে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ে আর ওই শ্রেণির দেশীয় পণ্য সুরক্ষা পায়। নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে এক হাজার ৫২০টি পণ্যের মধ্যে এক হাজার ৩৫০টির ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এতে আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ায় এই শ্রেণির দেশীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়বেন। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের দাবি, ‘দেশীয় শিল্পের স্বার্থরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখতে হবে’।

ব্যবসায়ীদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে ভ্যাট আইনে সংশোধন আনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ভ্যাটের একটি ‘স্বস্তিদায়ক’ হার নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বুধবার (১০ মে) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) মূসক অনলাইন প্রকল্পের ‘হেল্প ডেস্ক’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেছেন।

(দ্য রিপোর্ট/এমকে/জেডটি/মে ১০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর