thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বিচারক অপসারণ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি

‘সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে কি হবে?’

২০১৭ মে ২৫ ২০:৩৯:২৬
‘সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে কি হবে?’

দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : কোনো দলের সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে বিচারক অপসারণ কিভাবে হবে, এমন প্রশ্ন রেখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের হাতে প্রদান করে আনা সংবিধানের ষোড়ষ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে বৃহস্পতিবার (২৫ মে) তিনি এ প্রশ্ন রাখেন।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমরা দেশের সবচেয়ে পবিত্র আইন (সংবিধান) সংরক্ষণ করি। দেখা গেল সেখানে এমন কিছু সন্নিবেশিত হলো, যাতে শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তখন কী হবে? তখন জুডিসিয়ারি কী করবে? পার্লামেন্টে টু থার্ড মেজরিটি (দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা) না থাকলে ওই পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে তখন কী হবে? আমাকে এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে।’

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চে সপ্তম দিনের মতো এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা পাঁচে আদালত বসলে অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। টানা দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য অসমাপ্ত অবস্থায়ই আরেক অ্যামিকাস কিউরি প্রবীণতম আইনজীবী টিএইচ খান নিজের শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে বক্তব্য উপস্থাপনে আদালতের কাছে অনুরোধ জানান।আদালত সঙ্গে সঙ্গে তাকে সে সুযোগ দেন।

টিএইচ খানের পক্ষে তার ছেলে আফজাল এইচ খান লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অল্প সময়ে টিএইচ খান তার বক্তব্য শেষ করলে আবারও লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন রোকনউদ্দিন মাহমুদ। এরপর ১১টায় বিরতিতে যান আদালত। বিরতির পর আবার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বক্তব্য দেন। তার বক্তব্য শেষ হলে আরেক অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

ষোড়শ সংশোধনী যে সংসদে পাশ হয়েছে সে সংসদ যে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে সেই নির্বাচনকেই অবৈধ বলে বক্তব্য দিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী টিএইচ খান। আদালতে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করার পর তার ছেলে আফজাল এইচ খান সাংবাদিকদের বলেছেন, উনি হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। ওই রায়ে বলা হয়েছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল এবং সংবিধানের সংঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটাকে বাতিল করে দেওয়াটাই শ্রেয়।

টিএইচ খান আরও বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এটাকে একটা নমিনাল বডি না করে সেখানে একটা ফাংশনাল বডি করে ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত।

টিএইচ খানের বক্তব্য শেষ হলে আবার শুনানি শুরু করেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। শুনানিতে তিনি সংবাদ পত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে বিচারপতিদের নিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের করা মন্তব্য তুলে ধরেন।

একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন উদ্বৃত করে আদালতে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘তোরে জজ বানাইছে কেডা’-পত্রিকায় এরকম দেখেছি। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এরকম কথা বলে তাদের হাতে এটা (বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা) ছেড়ে দিবেন? তখন জুডিশিয়ারির স্বাধীনতা থাকবে?

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের জজ নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সদস্যরা আলোচনা করেছে। কিন্তু স্পিকার টু শব্দ করেনি। বলছি না আপনাদেরও (বিচারপতিদের) ত্রুটি নেই, দোষে গুণে মানুষ।

ব্যারিস্টার রোকন প্রশ্ন রাখেন, সিভিল সার্ভিসের ব্যক্তিদের কারা অপসারণ করে? পুলিশকে কারা করে? সেক্রেটারিদের কারা করে? আপনি? সংসদ? কেউ না। তাদের উপরস্থরা অপসারণ করে। অর্থাৎ সহকারী সচিবদের তদন্ত করে যুগ্ম সচিবরা। পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। মিলিটারিদেরটা তাদের ডিসিপ্লিনারিতে আছে। তাহলে আপনাদেরটা কেন পার্লামেন্টে যাবে? সচিব, পুলিশ এটা তো সংসদে যাচ্ছে না। তাহলে এটা কেন?

রোকনউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে এখানে অরাজকতা হবে। আর এটা (ষোড়শ সংশোধনী) যদি হয়ে যায় তাহলে হাইকোর্টের জজদের তো আপনি (প্রধান বিচারপতি) কিছু বলতে পারবেন না। ওনারা যদি ১১টায় আসে তখনও কিছুই বলতে পারবেন না। অথবা খাস কামরায় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যখন কথা বলবেন, তখন সংসদ কি দেখবে? এটা সংসদ জানবেও না। তাকে (সংসদকে) কে জানাবে?

সপ্তম দিনের শুনানিতে সবশেষে অসমাপ্ত বক্তব্য তুলে ধরেন ব্যারিস্টার এম আমীর–উল ইসলাম। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ উত্থাপন হয় তাহলে জুডিশিয়ারি তদন্ত হবে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে যেসব সমস্ত আইন-কানুন রয়েছে, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ইউরোপ বা কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলোতে যে সমস্ত রুলস দেখা যাচ্ছে, সব জায়গায় এখন জুডিশিয়ারি যে কম্পিটেন্স এবং তাদের যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং তাদের যদি কোনো ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন প্রয়োজন হয় ওইটা তারা নিজেরাই করবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানেও সে রকম একটা পদ্ধতি চালু আছে যা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সুতরাং তারাই এটা বিবেচনা করবে। পার্লামেন্টারি রিমুভাল কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না। ভারত, শ্রীলংকা, মালোয়েশিয়াতেও। সেখানে আরও বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হয় এ নিয়ে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছি। এখন মতামত দেবেন আদালত। বেশির ভাগ দেশই সংসদ থেকে ফিরে এসেছে। তারা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের উপরই দায়িত্ব দিয়েছে। যদি কোন জাজ ভুল করে তার বিচার জুডিশিয়ারিই করবে।

৭২-এর সংবিধানের প্রণয়নের সময় আপনারা এটি সংসদের হাতে কেন দিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, তখন তো আমরা জুডিশিয়ারি গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের প্রধান বিচারপতি কে হবেন সেটাও বঙ্গবন্ধু ফেরার পর ১০ জানুয়ারি, ১১ জানুয়ারি আমরা প্রধান বিচারপতি খুঁজছি। কাউকে তো শপথ নিতে হবে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সায়েমকে নিয়ে আসলাম। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তো সামরিক শাসকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সময়ের কারণে সে সময়ে আমরা জুডিশিয়ারি গড়তে পারিনি। তখন আপাতত সংসদের হাতে দিয়েছি। কেননা তখন সংসদ ছাড়া আর কিছু গড়ে ওঠেনি।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। পরে সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাই কোর্টে একটি রিট করেন।

ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাই কোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। হাই কোর্টের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

(দ্য রিপোর্ট/কেআই/জেডটি/মে ২৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর