thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল 24, ১২ বৈশাখ ১৪৩১,  ১৬ শাওয়াল 1445

রমজানে ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকি ও করণীয়

২০১৭ মে ২৭ ১৪:১৩:৪১
রমজানে ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকি ও করণীয়

ডা. শাহজাদা সেলিম

পৃথিবীতে জনসংখ্যার প্রায় ২৬ ভাগ (২০০ কোটি) মুসলমান। বর্তমানে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন। আগামী ২০৪০ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৪২ মিলিয়নে। সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ ব্যক্তিরা রোজা রাখেন। পৃথিবীর মোট প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের ৩৬ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। সে হিসাবে, প্রতি রমজান মাসে নয় থেকে ১২ কোটি ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা পালনকারী রোগীদের ৪৩ শতাংশ টাইপ-১ ও ৭৯ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন।

এ সময় রোজাদারকে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুম ভেদে এ সময়কাল ১৪ ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে সাহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা হতে পারে। এতক্ষণ একজন ডায়াবেটিক রোগী অভুক্ত থাকা উচিত কি না-তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে মুসলিম ও অমুসলিম বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে মত দিয়েছেন ডায়াবেটিক রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর। কোরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে (সুরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫)।

অন্য যেকোনো অসুখের চেয়ে ডায়বেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বিপর্যস্ত বিপাকতন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে তাদের শরীরে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। তার পরও কিছু কিছু রোগী রোজা রাখতে জেদ করেন। কোনো ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ রোগীকে রোজা রাখার পরামর্শ দেবেন না। আবার রোগী রোজা রাখতে চান তবে তাকে নিষেধ করাও সম্ভব না। এখানে রোজা রাখার কারণে তাদের যেসব সমস্যা হতে পারে ও তা থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।

রোজা রাখার ঝুঁকিসমূহ

১. রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া : খাদ্যগ্রহণে অনেকক্ষণ বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রোজার কারণে এতটাই কমে যেতে পারে যে, অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। টাইপ-১ রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হওয়ার সম্ভবনা ৪.৭ গুণ ও টাইপ-২ এর ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি।

২. রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া : রোজা রাখার কারণে টাইপ ১ ও টাইপ ২ উভয় ধরনের রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। তবে টাইপ-১ রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে জীবননাশের ঘটনাও ঘটতে পারে।

৩. ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস : টাইপ-১ রোগীদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে বা কিটোনবড়ি বেড়ে যাওয়ার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থা হতে পারে। বিশেষ করে যাদের গ্লুকোজ রোজা শুরুর আগে সঠিক মাত্রায় ছিল না।

৪. পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোসিম : দীর্ঘ সময় পানি গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। গরম ও বেশি আর্দ্র আবহাওয়ায় পানিশূন্যতা আরও প্রকট হতে পারে। যাদেরকে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয় তাদেরও পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া, রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার হার অনেক বেড়ে যায়। এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরাতে পারে। বিশেষত ডায়াবেটিসের কারণে যাদের স্নায়ুবিক সমস্যা আছে তাদের এ সময়ে জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আঘাত ও হাড় ভাঙার ঘটনা ঘটাতে পারে। পানিশূন্যতার কারণে রক্ত জমাট বেধে থ্রম্বোসিস হয়ে রেটিনার কেন্দ্রীয় শিরা বন্ধ হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারাবার ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে।

ব্যবস্থাপনা

ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। যা স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ চিকিৎসকের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীই রোজা রেখে কম-বেশি ঝুঁকির আওতায় চলে আসেন। তাই নিচের বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখুন।

- প্রত্যেক রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্র্যসহ বিবেচনা করতে হবে।

- ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন বেশ কমপক্ষে তিনবার এ কাজ করতে হবে। গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

- খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতো রাখতে হবে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০-২৫ ভাগ ডায়াবেটিক রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ ও তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। এসব খাবার হজমে সময় লাগে। কিন্তু ইফতারের পর রক্তে যত দ্রুত সম্ভব গ্লুকোজ সরবরাহ করতে হবে। তাই জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সাহরিতে খান। ইফতারিতে সহজপাচ্য খাবার, প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সাহরি সময় শেষ হওয়ার ঠিক আগে খেতে হবে এবং তার পর প্রচুর পানি পান বাঞ্ছনীয়।

-শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকেল বেলায় করতে যাবেন না। তারাবি নামাজকেও শারীরিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী (বিশেষত টাইপ-১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিকমতো রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাত্মক হয়।

- হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ, চিনি বা মিষ্টি কোনো খাদ্য বা শরবত খেতে হবে। যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবেন। যাদের অভিজ্ঞতা হয়নি তাদের বুক ধড়ফরানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা ভাব, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বাড়া, চোখে অন্ধকার, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণের দেখা দেবে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হয়েছে ধরে নিতে হবে। আবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেওয়া জরুরি। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইন ইউরিয়া মেগ্লিটিনইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশি। রক্তের গ্লুকোজ ১৬৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।

রমজান পূর্ব মূল্যায়ন

যারা ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে রোজার কমপক্ষে এক মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা।

সবাইকেই তার সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসরা এ ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবেন মাত্র।

লেখক
ডা. শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
চেম্বার : কমফোর্ট ডক্টরস্ চেম্বার
ফোন : ৮১২৪৯৯০, ৮১২৯৬৬৭ এক্স- ১১৯
মোবা : ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭, ০১৯১৯০০০০২২

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর