thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

বরিশালে ফের বাড়ছে আর্সেনিক রোগী

২০১৭ মে ২৭ ২০:৫৯:০২
বরিশালে ফের বাড়ছে আর্সেনিক রোগী

বিধান সরকার, বরিশাল : ফের আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর দেখা মিলছে বরিশালে। তবে গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সরকারের বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ কর্যক্রম। এ নিয়ে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে নতুন কোনো তথ্য না থাকায় তাদের কোনো পরিকল্পনাও নেই আপাতত। আর এই দপ্তরের পুরানো তথ্যও অনেকটা দায়সারাগোছের। চার বছরাধিক সময় ধরে ওষুধ ব্যবহার করতে না পেরে আক্রান্তরা হাত-পায়ের তালু ফাটা থেকে শুরু করে কিডনি ও হৃদরোগের মতো সমস্যায় ভুগছেন।

এ বিষয়ে বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুচ জানিয়েছেন, আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের ওষুধের বিষয়ে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন।

বিশ বছর আগে ঝালকাঠি জেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালিগোনা গ্রামের নাছিমা বেগম বধূ হয়ে এসেছিলেন বরিশাল সদর উপজেলার সাপানিয়া গ্রামের সিকদার বাড়িতে। স্বামী মো. আলতাফ সিকদার রাজ মিস্ত্রির কাজ করতেন। গভীর নলকূপ বসানোর সামর্থ ছিল না বলে বাড়ির সবাই মিলে অগভীর নলকূপের পানি পান করতেন। নাছিমা বেগমের বিয়ের দুই বছরের মাথায় এই বাড়িতে আর্সেনিক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই সময় তার ভাসুর রশীদ সিকদারের ছেলে জাহাঙ্গীর আক্রান্ত হলে ডাক্তার দেখালেও প্রথমে রোগ নির্ণয় করতে যায় নি। পরে বাড়ির অগভীর নলকূপের পানি পরীক্ষা করানোর পর জানতে পারা যায় যে জাহাঙ্গীর আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন । এর এক বছরের মাথায় ২২/২৩ বছরের তরতাজা যুবক জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়।

কেবল জাহাঙ্গীর নয়; পশ্চিম সাপনিয়া গ্রামের সিকদার বাড়ির ৭টি ঘর থেকে এক এক করে পর্যায়ক্রমে ১৪ জন মারা যান অর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে জাহাঙ্গীরের ভগ্নিপতি কাগাশুরা গ্রামের খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, তার স্ত্রী পারুল বেগম, শ্বশুর রশিদ সিকদার, শ্যালক জাহাঙ্গীর মিলি মোট ৫ জন মারা যান। আর আমীর আলী সিকদার, শামসু সিকদার, ইসমাইল সিকদার, সাহেব আলী সিকদারের পরিবার থেকে ২ জন করে এবং আলতাফ সিকদারেরর ঘরের ১ জন করে লোকের মৃত্যু হয়। ওই সময় জাহাঙ্গীরের তৎপরতায় বাড়িটিতে গভীর নলকূপ বসানো হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আক্রান্তদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১০ সালের পর এই ওষুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে ফের নতুন করে শরীরে গুটি দেখা যাচ্ছে বলে জানালেন গৃহবধূ আকলিমা বেগম।

তিনি জানিয়েছেন, সরকার থেকে দেওয়া গভীর নলকূপের পানি পান করছেন। এরপরও নতুন করে এই রোগ দেখা দেওয়ায় তারা চিন্তিত। এ সময় মো. সেলিম (৩৫) তার বুক পিঠ দেখায়ে বলেছেন, ‘পুরো শরীরে ফের অর্সেনিকের কারণে সিট পড়েছে। পায়ের তলা ফেটে যাওয়ায় হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখিয়েছি, তবে গরীব হওয়াতে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে পারছিনা। আর সরকারি ওষুধ যা দিত তা বন্ধ হওয়ায় এখন আমাদের রোগাক্রান্ত হয়ে মরণ ব্যতীত ভিন্ন কিছু দেখছি না।’

এলাকার লোকজন দাবি করেছেন, পুরো সাপানিয়া গ্রামই আর্সেনিক কবলিত এলাকা। সিকদার বাড়ির সদস্যদের অভিযোগ, তারা সরকার থেকে বসানো গভীর নলকূপের পানি পান করার পরও ফের আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছেন।

গৃহবধূ নাসিমা বেগম জানিয়েছেন, তাদের বাড়ির গভীর নলকূপের পানিতে প্রচন্ড আয়রন। এই পানিতে গোছল করলে ঠান্ডা লাগে ও শরীরে চুলকানি হয়। তিন বছর আগে পানি পরীক্ষা করেছিল, তখন ‘সমস্যা একটু আছে’ এমন বললেও সরকারি লোকজন আর আসে নি । এই গভীর নলকূপের পানি পান করছেন, এরপরও রোগ আজো ভালো হয়নি; উল্টো কিডনি ও হৃদরোগের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে ডাক্তার তাকে জানিয়েছেন।

এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম সহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, অগভীর নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ের হওয়াতে তাদের পক্ষ থেকে গভীর নলকূপ বসানো শুরু হয়। জেলায় ২৫ বছর ধরে শুরু হওয়া এই কার্যক্রমের আওতায় এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার নলকূপ বসানো হয়েছে। আগে যেখানে একশ পরিবারের জন্য একটি গভীর নলকূপ দেওয়া হতো, বর্তমানে তা ৫০ পরিবারের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো জানিয়েছেন, তাদের অধিদপ্তরের বসানো নলকূপে কোনো আর্সেনিক নেই। তারা পানি পরীক্ষা করে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই ঠিকাদারদের বিল দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও তারা এসব নলকূপের পানি এনে পরীক্ষা করে দেখেন নিয়মিত। তবে অন্য দপ্তরের বসানো গভীর নলকূপের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। ঠিকাদাররা যদি উপযুক্ত লেয়ার পর্যন্ত পাইপ না বসায় বা বসানোর সময় পাইপ ফেটে গেলে পানিতে সমস্যা দেখা দেবে। তিনি দাবি করেছেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বসানো ৮০ ভাগ গভীর নলকূপই এখন আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না।’

পোল্ট্রি এবং গরুর খামারে অগভীর নলকূপের পানি ব্যবহার হয় বলে এতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক পানি পরীক্ষাগারের সিনিয়র রসায়নবিদ সামসুদ্দিন আহমেদ। তাদের ১৯৯৭ সালের এনভারমেন্টাল কনজারভেশন রুল অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে দশমিক শুণ্য ৫ মিলিগ্রাম আর্সেনিক মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অগভীর নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতির গড় মাত্রা হলো শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ যেখানে পানিতে আয়রনের উপস্থিতি বেশি সেখানে আর্সেনিকের পরিমাণ ক্ষতিকর পর্যায়ে।

এই কর্মকর্তা আরো জানিয়েছেন, অগভীর নলকূপের ব্যবহৃত পানি মুরগী বা গবাদি পশু পান করলে ডিম বা মাংসে আর্সেনিক বাসা বাঁধে। এই ডিম বা মাংস খেলে মানবদেহে সহজেই আর্সেনিক প্রবেশ করে। একমাত্র আর্সেনিক রিমোভাল প্লান্ট বসিয়ে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

সর্বশেষ ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আর্সেনিকোসিস রোগীদের জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই সময় রোগের উপসর্গ লেখা ছিল-মেলানোসিস, কেরাটোসিস । প্রতিদিন একটি করে ফিউফল ও রেক্স ট্যাবলেট ৩ মাস করে খাওয়ার জন্য এবং হাত-পায়ে ২ বেলা লাগানোর জন্য মলম দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, নিকটবর্তী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে পরবর্তী ওষুধ আনার জন্য।

তবে রোগীদের অভিযোগ, ২০১০ সালের পর তারা আর ওষুধ পান নি। এ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল চন্দ্র মণ্ডল জানিয়েছেন, ২০১৩ সালের পর আর্সেনিকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায় নি বলে এ নিয়ে তাদের নতুন কোনো কর্মসূচিও ছিল না। তবে ফের আর্সেনিকোসিস রোগের উপস্থিতি নিয়ে কথা ওঠায় তারা ঘটনাস্থলে টিম পাঠিয়ে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এই দপ্তর থেকে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ৫১৮ জন রোগীর কথা উল্লেখ থাকলেও উপজেলা ভিত্তিক হিসেবে এই তথ্যের কোনো মিল নেই।

সিভিল সার্জন অফিসে হালনাগাদ প্রতিবেদন বা এই রোগের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তৎপরতা না থাকায় এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন স্বাস্থ্য কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুচ জানিয়েছেন, নীরব ঘাতক আর্সেনিকোসিস রোগের পরিণতি মৃত্যু, তা তিনি জানেন।তবে বর্তমান অবস্থা বা রোগীদের ওষুধ বন্ধ অবস্থা নিয়ে তাকে কেউ অবহিত করে নি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, সংসদের আসন্ন অধিবেশনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলবেন তিনি; যাতে করে রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে পারে।

(দ্য রিপোর্ট/জেডটি/মে ২৭, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর