thereport24.com
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ৯ শাওয়াল 1445

বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের জীবনচিত্র

২০১৭ মে ২৮ ১১:০৯:৩৯
বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের জীবনচিত্র

রাজিউর রহমান রাজু, পঞ্চগড় : ঘরে ঘরে জ্বলছে বিজলি বাতি, চারদিকে চলছে রাস্তা পাকাকরণের কাজ, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল-কলেজ, প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে স্যানিটারি ল্যাট্রিনসহ নলকূপ, দল বেধে শিশুরা ছুটছে স্কুলের দিকে-এমনই চিত্র এখন পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে।

দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনা অবসানের মাত্র দুই বছরের মাথায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষের জীবনচিত্র।

১৯৭৪ এর স্থল সীমান্ত চুক্তি (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিনিময় হয় ১৬২টি ছিটমহল। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ড হয়ে যায়।

এতে দুই দেশেরই মানচিত্র পায় পূর্ণতা আর ছিটমহলবাসী পায় দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি। অবসান ঘটে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর মানবিক সমস্যার।

এদিকে ৬৮ বছর পিছিয়ে পড়া ছিটমহলবসীদের উন্নয়নে গত দুই বছরের মধ্যে সরকার হাতে নিয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলার তিনটি উপজেলায় ৩৬টি ছিটমহলের মধ্যে ১৭টিতে জনবসতি রয়েছে। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাধ্যমে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ১০৫ দশমিক ২৫ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ, ১৯৩ মিটার ব্রিজ তৈরি, ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার খাল খনন, ১১টি বাজারে শেড স্থাপন, সাতটি মসজিদ ও পাঁচটি মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরে প্রাক্কলিত ৮২ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

জেলা পরিষদের মাধ্যমে ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলুপ্ত ছিটমহলবসীদের উন্নয়নে ২৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য, সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত ছিটমহলের ৩০০ জন কিষান-কিষানিকে প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ ও প্রদর্শণী খামার তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত কোটভাজনি ছিটমহলে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে দীর্ঘদিনের সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা নিয়মিত তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন।

শিক্ষার উন্নয়নে জেলা প্রশাসন ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাহিদা দিলেও পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৪২টি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে নিয়মিত পাঠদান চলছে। সেই সঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অর্থায়নে একটি টেকনিক্যাল স্কুলসহ দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া স্থানীয় উদ্যোগে বিভিন্ন বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় অর্ধশতাধিক স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ গড়ে উঠেছে যেগুলোতে নিয়মিত পাঠদান অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) মাধ্যমে তিনটি উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পাঁচ শতাধিক মানুষকে সম্পৃক্ত করে ১৫টি গ্রাম উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এক হাজার ১৬৫ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৪৯১ জনকে বিধবা ভাতা এবং ৩২৪ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার হাস-মুরগিকে টিকাদান ও ৭০০ জন অসচ্ছল নাগরিকের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণী (গরু, ছাগল, সোনালি মুরগি ও হাঁস) বিতরণ করা হয়েছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জীবনমান উন্নয়নে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ২৫০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণ করা হয়েছে এবং নয় হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দখলের ভিত্তিতে প্রাক-জরিপ শেষে ডিজিটাল সার্ভে করা হয়েছে। এবং ভূমি রেকর্ডের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্বের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং তাদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। ২০১১ সালের হেডকাউন্টিং অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পঞ্চগড়ের তিনটি উপজেলার ছিটমহলগুলোতে ২০ হাজার মানুষের গেজেট প্রদান করা হয়েছে। সে মোতাবেক ইতোমধ্যে নয় হাজার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং তারা ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

অধিভুক্ত এই ছিটমহল এলাকাগুলোকে ভাগ করে সংযুক্ত করা হয়েছে পার্শ্ববতী ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সাথে। সেখান থেকেই ইতোমধ্যে তারা পেয়েছেন ভিজিএফ-এর চালসহ নানান সুবিধা। দেওয়া হয়েছে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও বিশুদ্ধ পানির জন্য বিতরণ করা হয়েছে অগভীর নলকূপ।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩৮০ জনকে মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং তিন হাজার ২৫০ জনকে ভিজিডি কার্ড প্রদান করা হয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের অওতায় বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্যচাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জলাশয়ে এক হাজার ৮০০ কেজি পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিলুপ্ত ছিটমহলের গৃহহীন ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের জন্য গুচ্ছগ্রাম ২য় পর্যায়ের (সিডিআরপি) প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যায়ে ৩০টি পরিবারের জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত কোট ভাজনী ছিটমহলের বালাসুতি এলাকায় একটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে।

অপরদিকে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজগুলোতে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রয়েছে।

সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের রাজমহল উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া জাহান স্বপ্না বলেন, ‘আগে আমাদের মিথ্যা পরিচয়ে বাইরের স্কুলে পড়ালেখা করতে হতো এখন আমরা আমাদের বাড়ির পাশের স্কুলে পড়তে পারতেছি। বাংলাদেশ হওয়ার পর আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আসায় এখন আর পড়ালেখায় সমস্যা হয় না। আগে কুপি-বাতি দিয়ে ভালোভাবে পড়তে পারতাম না।’

বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘আগে কখনো স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিল না আমাদের বাড়িতে এখন আমরা টিউবওয়েল, ল্যাট্রিন সব পেয়েছি। এই যে বাড়ির সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা হচ্ছে বুকটা গর্বে ভরে উঠছে। আগে আমাদের বিচার-সালিশ ছিল না; এখন আমরা আইনের আশ্রয় নিতে পারি, এ জন্য সরকারকে অনেক ধন্যবাদ।’

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘পঞ্চগড় জেলার তিনটি উপজেলায় ৩৬টি ছিটমহল বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এই পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা সরকারের বিশেষ গুরুত্বের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। দীর্ঘদিনের পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে মূল গোত্রের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জীবনযাত্রা আমূল পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর জন্য নেওয়া সরকারের সকল প্রকার উন্নয়ন কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জানান।’

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি অধুনালুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে পঞ্চগড়েই ১১ হাজার ৯৩২ দশমিক ৮০ একর এলাকাজুড়ে রয়েছে ৩৬টি ছিটমহল। যার লোক সংখ্যা ২০ হাজার ৭১ জন।

(দ্য রিপোর্ট/এম/মে ২৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর