thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৭ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

ম্যাডাম, আপনি কাদের পুলিশে দিলেন?

২০১৭ মে ২৯ ২০:৩৭:৫৭
ম্যাডাম, আপনি কাদের পুলিশে দিলেন?

খাদেমুল ইসলাম : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন থেকে গ্রেফতার হওয়া ৪২ জন (১২ জন ছাত্রীসহ) শিক্ষার্থী রবিবার সন্ধ্যার দিকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে। মুক্ত হয়ে শাহবাগে নেমেই তাদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শাহবাগ চত্বর। পরে সেই সন্ধ্যাটা সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। এক রাত থানায় কাটানো অতঃপর জামিনে মুক্তি পাওয়া এই ছোট ভাইবোনদের চোখে-মুখে কোনো বিচলতা দেখিনি। তাদেরকে অনেক প্রত্যয়ী মনে হয়েছে। তারুণ্যের এই দৃঢ়তা সত্যি প্রশংসনীয়।

গত শুক্রবার সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সিএন্ডবি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি তরতাজা প্রাণ নিভে গিয়েছে। নিহত দুই শিক্ষার্থী হলেন- মার্কেটিং বিভাগের নাজমুল হাসান রানা (২২) ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের মেহেদী হাসান আরাফাত (২২)। দু’জনই ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের আবাসিক ছাত্র ছিল।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠীদের এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। ক্ষোভের আগুন কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে লাশ নিয়ে প্রশাসনের রাজনীতি। ক্যাম্পাস সংলগ্ন রাস্তায় দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর লাশ সহপাঠীদের একনজর দেখার জন্য ক্যাম্পাসে নিতে দেয়নি। এটাই ছিল প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেই ভুলের সূত্র ধরেই শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহসড়ক অবরোধ করে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে।

ঘটনার বিচার ও নিহত ছাত্রদ্বয়ের পরিবারের ক্ষতিপূরণে প্রশাসন সোচ্চার হলে ছাত্র-ছাত্রীদের এভাবে মাঠে নামতে হতো না। একজন নারী উপাচার্য হিসেবে মা’র ভূমিকা থেকে অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম এই দুই ছাত্রের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহ মনে হয় মায়ের মমতার চেয়েও শক্তিশালী। তাই তো এই প্রশাসন দুই শিক্ষার্থীর লাশই ক্যাম্পাসে নিতেই দেয়নি।

শেষ অবধি পুলিশের গুলি আর টিয়ারশেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে রাস্তা ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। একজন শিক্ষার্থীকে পিঠে নল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আহতদের সাত/আটজন এখনো চিকিৎসাধীন। আরেকজন আহতকে চিকিৎসা দেওয়ার সময় হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

ইতোমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট এই ঘটনায় আশুলিয়া থানার ওসিকে তলব করেছেন। আগামী ৩১ মে উনি হয়তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাত দিয়ে ‘দুর্বৃত্ত’ এর হাতে হাতকড়া পড়ানোর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করবেন।

এ সব দেখে কষ্ট হয়। বাংলাদেশ সত্যি কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র! গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটা দেশের পুলিশ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঢুকে এ ধরনের কাজ করতে পারে? এই বাস্তবতা দেখেও সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র নির্যাতনের ঘটনার পর সেনা সমর্থিত সরকারের আচরণ দেখেছি। সেদিন আমরা ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেমেছিলাম। কারফিউ জারির পূর্ব পর্যন্ত সেনাবাহিনীও ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এতোটা খারাপ আচরণ করেনি।

এমনকি ২০০৭ সালের ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় কারফিউ জারির পর সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে হল ভ্যাকেন্ট করা হলেও ক্যাম্পাসে নির্যাতনের মাত্রা এই পর্যায়ে ছিল না। রাতের অন্ধকারে অবশ্য বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের উপর সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া গেছে।

যাই হোক, এখন তো কোনো সেনা সমর্থিত সরকার নেই দেশে। তাহলে কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ থামাতে ক্যাম্পাসে শত শত পুলিশ লাগবে। কেন অর্ধশত শিক্ষার্থীকে মামলা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে?

মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আমাদের প্রশ্ন, আপনি কাদের পুলিশের হাতে তুলে দিলেন? আপনি তো মায়ের জাতি। একজন সন্তান হারানোর বেদনা আপনার ভাল বোঝার কথা। সংগত কারণেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েই আপনারও বিচারের জন্য সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। শিক্ষার্থীরা মাঠে নামার আগেই সরকারের উচ্চ মহলে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।

উল্টো আপনার প্রশাসন শোকার্ত ক্যাম্পাসে লাশ নিয়ে পর্যন্ত ঢুকতে দিল না। বিচার আর ক্ষতিপূরণ তো পেছনেই থেকে গেল। এর জেরেই আসলে রাস্তায় নামতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সেই প্রতিবাদের জেরে শিক্ষার্থীদের উপর যে পুলিশি নির্যাতন চালানো হয়েছে, সেটা নজিরবিহীন। আর নিজের সন্তানকে কি না আপনি মামলা দিয়ে তুলে দিলেন পুলিশের কাছে? আসলে আপনি কেমন মা? সেই প্রশ্ন কিন্তু এসেই যায়।

মানছি গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বড় একটা অংশ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মী। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মীও রয়েছে বেশ কয়েকজন। কিন্তু ক্যাম্পাস সংলগ্ন সড়কে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনার বিচার, নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান তো কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়।

তাছাড়া যাদের পুলিশ গ্রেফতার করে, তাদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও বাদ যায়নি। জামিনে মুক্তির পর রবিবার সন্ধ্যায় শাহবাগের মোড়ে গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। যার মধ্যে একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তারা শুধু অবস্থা দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন। একজন বলল, ভাই কখনো তো বাম রাজনীতি করিনি; কিন্তু এখন তো জোর করেই বাম বানিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের এসব যৌক্তিক দাবি পাশকাটাতে গিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের গেট আটকে তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির ঘোষণা আগেই ছিল। নতুন করে হল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে।

এ অবস্থায় গত রবিবার ৪২ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে জামিনদার হওয়ার লোকও ঢাকার আদালতে ছিল না। সহপাঠীদের একজন জানাল, একাই সাতজনের অভিভাবক হিসেবে জামিননামায় স্বাক্ষর করেছেন। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে!

তথাপি প্রতিবাদী ক্যাম্পাস জাবির এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছে এটাই আশাবাদী হওয়ার মতো। তারুণ্যের এই শক্তিই একদিন গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিপীড়ক নিপাত যাক, প্রতিবাদ চিরজীবী হোক।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও সাবেক শিক্ষার্থী, জাবি

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর