thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

কাকটি দেখেছিল, সে বৃষ্টিতে ভিজেছিল

২০১৭ জুন ০৭ ১১:৫৫:১১
কাকটি দেখেছিল, সে বৃষ্টিতে ভিজেছিল

মাশুক শাহী

আজ ওর মোটেও অফিসে যেতে ইচ্ছে করছিল না । তবুও গোলামি করতে গেলে তুচ্ছ-ম্লেচ্ছদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কিইবা আসে যায় সমাজ-সংসারের । মাঝরাত থেকে বৃষ্টির যে সন্ত্রাস শুরু হয়েছিল তা কমেছিল ভোররাতেই। কিন্তু পুরো এলাকাটিকে একবারে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে ফেলেছে । এই বৃষ্টির নরম হাওয়া মনকে করে তোলে সোহাগী। একটু অলস হতে, একটু অন্যরকম হতে তাড়িত করে । সেই তাড়নার মধ্যে যখন বসের চোখ এসে পড়ে তখন নবী এক লাফে উঠে দেয়াল ঘড়িতে চোখ ফেলতেই সমস্ত তাড়না-অলসতা যন্ত্রণায় পরিণত হয় । তার ক্ষিপ্রতায় আমিও চিংড়ি মাছের মত নাচতে থাকি। কারণ নাস্তা করতে হবে । বৃষ্টির কারণে বুয়াটা এখনও যখন আসেনি-আসবে না বলে ধরে নেয়া যায় । নিজ হাতে আধিভৌতিক ক্ষিপ্রতায় তিনটি রুটি,আলু ভাজি, ডিম ওমলেট করে তার সামনে ধরি । সে কোনোরকম খাওয়াগুলি মুখের ভিতর চালান করে । চায়ে চুমুক না দিয়েই গোলামি করতে চলে যায় । দোতলার নিচে নেমে গেলে মন খারাপ হয় । আশঙ্কা জাগে যে পরিমাণ পানি জমেছে তাতে ফুলপ্যান্ট খোলা না লাগে । এই ঐতিহাসিক সংস্কৃতিচর্চাসমৃদ্ধ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা । আমরা যেখানে থাকি । অথচ বর্ষা মৌসুমে একেবারেই অন্যরকম । ওর প্যান্ট খোলা কিংবা গুটানো লাগল কিনা দেখার জন্য প্রথম ঘরের পূর্বপাশের জানালায় দাঁড়ালাম কিন্তু পিয়াদের পেয়ারা গাছের জন্য কিছুই দেখতে পেলাম না । শেষে কোনার ঘরের পশ্চিম পাশের জানালায় দাঁড়ালাম । সাথীদের বাড়ীর ছাদের শেষ প্রান্ত দিয়ে চোখ এগিয়ে দিয়ে দেখলাম, মানুষটি প্যান্ট হাঁটুর উপর পর্যন্ত গুটিয়ে বেশ কসরত করে যাচ্ছে ভালোই। দৃশ্যটা বেশ স্বস্তি দিচ্ছিল-কেয়াদের পুকুরপাড় পর্যন্ত তাকে দেখা গেল । তারপর মোড় ঘুরতেই চোখের আড়াল । আমিও ফিরে আসলাম পূর্ব ঘরে, বৃষ্টি তখনও হচ্ছে । এমন বৃষ্টি এই বৃষ্টি-ঠিক ভেজায় না-ভাসায় না-ডোবায়ও না । মন-মেজাজের উপর একটু আলো-ছায়া, একটু আনন্দ-আনন্দ, একটু বেদনা-বেদনা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে থাকে । এই অবস্থায় বিছানার আহ্বানের কাছে নাস্তার উপযোগিতা নৃশংসভাবে পরাজিত হয় ।

ঘুমিয়েছিলাম, না ঝুলেছিলাম ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, চোখ খুলে দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি পড়তেই মাথা ঘুরতে থাকলো-মাথাঘুরণ অবস্থায় বুঝতে পারলাম বেশ ঘুমিয়েছি । এখন ওর দুপুরের খাবার খেতে আসার সময । কী করবো কী করবো না, নিজেও নাস্তা না করায় শরীরটা বিলীয়মান, টলায়মান । ঠিক এমন পরিস্থিতিতে ফোনটা বেজে ওঠে । টলতে টলতে ফোনটা ধরি । ওপাশ থেকে মধুশ্রুতি ভেসে আসে-আমি আসছি না-অফিস শেষ করেই আসবো । তুমি খেয়ে নিও । সম্ভাব্য খাটুনি থেকে মুক্তির আনন্দে ভাসতে ভাসতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসি-চমকে উঠি-আমার চোখে জল ! এই জল কি আনন্দের-এই জল কি বেদনার । নাকি নিঃসঙ্গতার-নাকি কোনো অপূর্ণতার । নাকি নারীর প্রাত্যহিক কাজ থেকে কিঞ্চিৎ মুক্তির স্বাদ? মুক্তি বললেও কি মুক্ত হওয়া যায় ? ওর জন্য না হোক আমার যে না খেলে নয় । চোখ পড়লো ডাইনিং টেবিলে-আমার দিকে তাকিয়ে কি হৃদ্যতায় রুটি দু’টি হাসছে, ভাঙ্গাচূড়া ওমলেটও আছে-আলুভাজিও বলছে আমাকে নাও । ওর না খেয়ে যাওয়া চা-টাও আছে । এদের দেখে আমি যে আনন্দ পাচ্ছি । এর আগে আমি এত আনন্দ পাইনি-পরে পাবো কিনা জানি না । শরীরে-মনে এত অবসন্নতা-এত দুর্বলতাও অনুভব করিনি কখনও । বাবুইয়ের বাসার মতো দুলতে থাকি । এখনই খাবো, না গোছল করে ঝরঝরে হয়ে খাবো । তবে যখনই খাওয়া হোক না কেন, গরম করা দরকার-দরকার একটু নিজের মত করে সাজানো । দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি থেমেছে- মেঘ সরেছে- আলোও ফুটেছে । ভেজা কাপড়গুলো কোথায় শুকাতে দেব । টিনের নিচে টানা তারে, না বাইরে টানা দড়িতে। ভাদ্রের বৃষ্টি কিশোরী উচ্ছতলার মত যখন তখন এসে পড়তে পারে । শেষে টিনের নিচে টানা তারেই কাপড় মেলে দিয়ে চুল ঝাড়ার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ালাম । চুল থেকে মমিননগরের গামছা খুলে পানি নিংড়িয়ে ডান হাত উপরে তুলে গামছাটা নিচ পর্যন্ত নামিয়ে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দড়া পাকালাম । পাকানো গামছা দুই হাত দিযে টান টান করে ধরে মুখটা উঁচু করে যেই চুলে মারতে যাবো তখনই, ঠিক তখনই প্রাণ কাঁপানো শরীর কাঁপানো- পৃথিবী কাঁপানো দৃশ্য আমার সামনে । ছাদে জমে থাকা পানি যাতে এক দিক দিয়ে যায় তার জন্য যে সিংগেল ইটের বেষ্টনী সেই বেষ্টনীর উপর গালে হাত দিযে বসে আছে ছেলেটি । এত হাল্কা-এত পলকাভাবে বসে আছে। সবচেয়ে কাছের মানুষ যদি প্রাণের নিবিড়তম আকুতি দিয়ে নিস্বরে ডাকে-তাতেই ঘটে যাবে ভয়াবহ-বীভৎসতম ঘটনা । হাত নাড়ানো থেমে যায় । ওকে ফেরাতে হবে । শুধু জপ করতে থাকি আমি যেন ওর পরিণতির উপলক্ষ না হই ! এমনভাবে বসে আছে পিছনটা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে । মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা দেখার জন্য দেখা দরকার তো সামনে । কিন্তু কোনো অবস্থায়ই ওর সামনে দেখা সম্ভব নয় । আবার বসে আছে দুই পা’র উপর ভর দিয়ে পাছা ঝুলিয়ে একবারে কার্নিশের শেষ সীমায় । কোনো শব্দও করা যাচ্ছে না । মুখটা যদি এক মুহূর্ত দেখতে পারতাম তাহলে মনঃপাঠ করেমনস্তাত্ত্বিক চর্চায় যাওয়া যেত । একটি প্রাকৃতিক শব্দের প্রার্থনায় ঈশ্বরের কাছে হাজার হাজার বার নতজানু হই । সাইকোলজিতে পড়া ও পড়ানো আমি বিপদাপন্ন হই । আশপাশের সম্ভাব্য হিসফিসের তীব্র বিষের সমগ্রতায় কাঁদতে কাঁদতে প্রস্তুত হই জীবন জয়ের ।

কাকটি উড়ে এসে বসে দোল খেতে থাকে । বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চরম বিরক্তিতে পাখা ঝাঁপটিয়ে তারস্বরে ডাকতে থাকে । তার বিদ্রোহের কারণ প্রতিদিন এই সময় এসেই দুপুরের খাবারের উচ্ছিষ্ট পায় । কিন্তু আজ কোনো কিছুই তো সে পায়নি- অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলো, যে দেয় তার কোনো ব্যস্ততা নেই বরং সে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । একদিকে ক্ষুধার জ্বালা আরেক দিকে অবহেলার তীব্রতায় কাকটি আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তারস্বরে কা-কা করে ডাকতে থাকে । হঠাৎ মনে হয় ছেলেটির শরীর নড়ে ওঠে-দুলে ওঠে । আশান্বিত হই-মনে হলো একটি পা মূল ছাদের উপর নেমে এলো । বৃষ্টিমিশ্রিত আলো-আঁধারীর মধ্যে ঠিক মতো বডিল্যাংগুয়েজও ধরা যাচ্ছে না । চোখ আপনি আপনি বুজে গেল । কাকটিও একবারে নির্বাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলো । ও হয়তো বুঝতে পারছে না ওটা মানুষ, না অন্য কোনো কিছু । দুই বছরের মধ্যে এমন দৃশ্য তো ওর চোখে পড়েনি । পাখি হলেও ঠিকই বুঝতে পেরেছে তার নিয়মিত উদরপূর্তির ব্যত্য় ঘটেছে এই বস্তুটির জন্য । সম্ভাব্য ভয়াবহতার আশঙ্কায় কাকটিও মাথা নিচু করে ঠোঁট ঘষতে থাকে নারকেল পাতায়, নিজেদের ধরে রাখতে না পেরে চোখের দু’পাতা এক হয়ে যায় ।

এই মহল্লায় প্রথম যেদিন আসি, এসেই মন খারাপ হযে গিয়েছিল । বিয়ের প্রায় এক বছরের সময় ওর বদলি হয় এখানে । এক বছরের সংসার । তেমন কিছু না থাকলেও বাঁধাছাদার পর দেখা গেল এক ট্রাকে কুলানো কঠিন হয়ে পড়ছে । ফলে অফিসের পিকআপ নিতে হয়েছিল । ট্রাক পৌঁছানোর আগে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম । পিকআপটা বাসা পর্যন্ত যাবে না এটা বুঝতে পেরে মনটা বেশ বিগড়ে গেল । ও যখন ভাবছে কি করা যায়, তখনই ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করে -

: আপনি তো সুইটির মামা। অসি আপাদের বাসায় এসেছেন । কোনো সমস্যা নেই । আপনি আলমগীর ভাইয়ের লন্ড্রীতে বসেন ।

: মামি চলেন । আপনি তো বাসা চেনেন না । কোনো চিন্তা করবেন না । সবকিছু পৌঁছে যাবে সময় মত আপনার ঘরে । আপনি শুধু বলবেন জিনিষপত্রের কোনটা কোন জায়গায় বসবে । সরু সলিং রাস্তা ধরে যতই মহল্লার ভিতর ঢুকি ততই মন ভালো হয়ে যায় । ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা, পড়াশুনা, ওখানেই বিয়ে । যখন প্রথম শুনলাম এখানে আসতে হবে তখন মনটা যে কি খারাপ হয়েছিল । এখন এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কিছুক্ষণ আগের অস্বস্তি-বিরক্তি কাটতে শুরু করেছে । আশপাশের বাসা থেকে উৎসুক দৃষ্টি । ছেলেটি বলেই যাচ্ছে সুইটির মামি-সুইটির মামি । তার উত্তরে তারা বলছে ও নবীর বৌ-নবীর বৌ। অভ্যর্থনা খারাপ হচ্ছে না । নবী এখানে গ্রহণযোগ্য বুঝতে পেরে আনন্দ হচ্ছে । এখানে দিনকাল বেশ ভালো যাবে বুঝতে পারছি । দোতালায় উঠলাম । উঠেই সামনে বিশাল মাঠ, আরেক পাশে পর পর কয়েকটি পুকুর দেখলাম । আমার আনন্দ দেখে কে ? হয়তো চেঁচিয়ে উঠতাম-হয়তো লাফিয়ে উঠতাম । কিন্তু সিঁড়ির গোড়ায় দুইজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে নিজেকে সামলালাম । হাজার হলেও নতুন জায়গা। উপরে উঠে পরিচয়ের আগেই আমাকে না দেখেই বললেন, তোমার না আরও আগে আসার কথা ছিল । কিছু বলার আগে- উনি মুন্নির মা, উনি রিতার মা, আমাদের ভাবী ।

: তোমার কোনো চিন্তা নেই । এই আমরা আছি, তুই সবাইকে নিয়ে যা ।

ও চলে গেল । দু’জন একসাথে বললেন, আজ তোমার রান্নার দরকার নেই । গল্পে গল্পে কখন যে দেড় দুই ঘন্টা চলে গেছে বুঝতেও পারিনি । বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম পিকআপের মালামালের সাথে ট্রাকের মালামালও আসছে । ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কে লেবার আর কে এখানকার ছেলে ।

: তোমার কোনো টেনশন নেই । সুইটির মা-ই বলে গেছে কোন জায়গায় কোনটা বসাতে হবে । আসো ধরো। ছোটখাটগুলো আমরা সাজিয়ে ফেলি ।

সবকিছু আনা শেষ হলে চা-বিস্কুট-মুড়ি চানাচুর দিয়ে আপ্যায়ন শেষে যখন লেবার বিদায় করা হলো। তখন বুঝলাম কারা পাড়ার ছেলে । কার সাথে কার কী সম্পর্ক । নবীও আসলো । এরপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় ঘরের চেহারা পাল্টে গেল । এমন কি বিয়ের ছবিও আমাদের পছন্দ মত আমাদের অজান্তে টানানো হলো । ভাবী আমরা আসি বলে ওরা চলে গেল ।

তোমরা দু’জন গোছল করে নাও । আমরা খাওয়া পাঠাচ্ছি ।

উনারা নিচে নেমে গেলেন । আন্তরিকতায় ভাসতে থাকলাম । আসার আগে যে কষ্ট ছিল মনে প্রাণে তা দূর হয়ে সেখানে সুরধ্বনি উঠছে । আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে । গান শুনে নবী খুবই খুশি । বলেছিলাম না গেলে আর ফিরতে পারবে না ।

ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরোতে না বেরোতেই দেখি খাওয়া আসা শুরু হয়ে গেছে । অতি নিখুঁতভাবে তারা ডাইনিং টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছে । ধুয়া উঠছে-গন্ধই বলে দিচ্ছে খাওয়ার স্বাদ । সাজিয়ে রাখার পর জানলাম একজন রিতা, আরেকজন মুন্নি । দু’জনের বয়সের ব্যবধান বেশ কিন্তু হৃদ্যতায় সমান্তরাল । নবী বেরোনোর পর আর কিছুক্ষণ থেকে ওরা চলে যাওয়ার পর দুজনই খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম । পরিমাণ দেখে তো ভিমরি খাচ্ছি । কিন্তু একসময় দেখলাম খাবার তেমন অবশিষ্ট নেই । বুঝলাম আন্তরিকতা, পরিবেশ ও প্রকৃতি কিভাবে মানুষের সবকিছুকে বড় করে তোলে । এমন কি খাবার ইচ্ছাকেও ।

সকালে ঘুম ভাঙলো না । ভাঙ্গানো হলো । দরজা খুলে দেখি মুন্নি আর একটি মেয়ে । দু’জনই সমবয়সী । আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখলো । কী নিখুঁত-কী সপ্রতিভ । মাতৃত্বের পিপাসায় ওদের দু’জনকে দুই বাহুতে তুলে নিলাম । এই অবস্থা দেখে নবীর চোখ নরম হয় আমি লজ্জা পাই। ওরা হাসতে হাসতে চলে যায় । এরপর ও অফিসে যেতেই বিভিন্ন বয়সী বিভিন্ন জনের আসা-যাওয়া চলতে থাকে । জমে ওঠে গল্পগুজব আড্ডা । এর মধ্যে থেকে ঐ ছেলেটির অটোবায়োগ্রাফিও জানা হয়ে যায় । সেই যে দেখা এরপর তার কোনো দেখা নেই । অনুপস্থিতির উপস্থিতি যে কত তীব্র কত সতেজ হতে পারে এই প্রথম বুঝলাম ।

অনেক অনেক দিন পর আসে কবি, দিবা রাত্রির কাব্য, রাত ভরে বৃষ্টি, পুতুল নাচের ইতিকথা, তীরন্দাজ নিয়ে, বইগুলি হাতে নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি । আমার বোঝা হয়ে গেল এ ওর বয়স থেকে অনেক এগিয়ে সময় থেকে অনেক অনেক এগিয়ে । এই ধরনের ছেলেরা প্রতিদিন একবার বাঁচে তো তিনবার মরে । এরা প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুযন্ত্রণা পান করে । এরপর ও যত না এসেছে সশরীরে তারচেয়ে বেশি এসেছে গল্প হয়ে-মীথ হয়ে । এই বয়সে ও যে পরিমাণ গল্প ধারণ করেছে কয়েক জীবনে অনেক মানুষ তা ধারণ করতে পারে না ।

সেই ছেলেটি এখন একটু ঘুরে বসেছে । সিংগেল ইট থেকে পা নামিয়ে ছাদে রেখেছে । চোখ খুলেই এটা দেখে আশান্বিত হলাম । দীর্ঘক্ষণ একদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ একটু স্বস্তি খুঁজছিল। কাকটি খোঁজ করলাম-দেখলাম বসে আছে নির্জীবভাবে । ওর জন্য কষ্ট হতে থাকে- প্রতিদিন এই সময় আসে আমার কাছে। উচ্ছিষ্ট দিয়ে মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে মূল্যবান সঙ্গ খরিদ করি । করুণভাবে একবার তাকিয়ে বিনয়ে মুখ নামিয়ে নিল । বুঝতে পারছি না কী করবো । এটুকু বুঝতে পারছি এখান থেকে সরা যাবে না- নড়াও যাবে না। কিন্তু সরতে হলো, সম্ভাব্য ভয়াবহতম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না হয়ে বরং পরোক্ষদর্শী হই । ঘরে ঢুকলাম।

সকালের নাস্তা যা ছিল এনে ফেললাম কাকের সামনে । নিয়মিত খাবার তালিকার ভিন্ন দেখে সে হকচকিয়ে গেল, আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার সংকট বুঝতে পেরে, কিছু না করে নারকেল গাছ থেকে নেমে এসে খেতে শুরু করলো । চোখ মুছে শংকিত প্রাণে তাকালাম উপরে-দেখি ও এমনভাবে আমাদের দেখছে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দৃশ্যাবলী, নিবিড়তম স্মৃতিরাজি অনুভব- অনুধাবন-পর্যবেক্ষণ করে যেতে চাচ্ছে। এখন-এখন আরও বিপজ্জনক ভাবে বসে আছে, সিংগেল ইটের উপর পুরো পাছাপাতা, পা দুটো সামনে । বসার জায়গা উচুঁ হওয়ায় পা দুটো ভাঁজ হয়ে উঠে এসেছে থুঁতনি বরাবর । দুই হাঁটু এক জায়গায় করে তার উপর থুঁতনি রেখে এই মানবিক দৃশ্য ঐতিহাসিকভাবে দেখছে । দৃশ্যটির পারিপার্শ্বিকতা, না বিষয়বস্ত কোনটা ওর কাছে প্রধান এটা বুঝতে না পারলে ওকে রক্ষা করা যাবে না । একটু উল্টে গেলেই মাথাটা প্রথমেই আছড়ে পড়বে ওদের রান্না ঘরের ছাঁদের কোণায় একটু এদিক-ওদিক হলে সুপুরি গাছের সাথে বারি খাবে । তাও যদি না হয়, তবে সোজা নিচে সলিং রাস্তায় পড়ার আগে তিন তিনটি কার্নিশের সঙ্গে বারি খেতে খেতে পড়বে । বীভৎসতার তাণ্ডব নৃত্য চেতনাকে অবশ করে ফেলে । ও মরার আগে আমি প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুবরণ করছি ।

: আপনার চোখে জল ?

: তুমি ওখানে কেন?

উত্তরের অপেক্ষায় সময় চলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই । বৃষ্টি আবারও শুরু হলো । চারদিকে অন্ধকার নামতে থাকে । নেমে আসে ওহী ।

: তপস্যা করছি ।

চোখের জল যখন দেখেছে ! কথোপকথন যখন শুরু হলো ! তখন মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে আনি ! প্রচুর কথা বলতে হবে ।

: কিসের তপস্যা ?

: মৃত্যুর!

আশার হাজার হাজার জীবন শিখা আমার মনে প্রাণে জ্বলতে থাকে । মৃত্যু সম্পর্কে যখন সচেতন রয়েছে । তখন ও ফিরবে-ফিরবেই । এবং ফিরিয়ে আনতে নিজেকে প্রকৃতিসংশ্লিষ্ট শিল্প করে তুলি, শিল্প কৌশলের সচেতন ব্যবহারে নিজেকে মেলে ধরি ।

: আর জায়গা ছিল না?

: হয়তো ছিল-হয়তো ছিল না ?

আশা এবং আশঙ্কা দুটোই সমানভাবে বাড়তে থাকে । বৃষ্টিও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে । আর সাথে পাল্লা দিয়ে হাজার গুণ আশঙ্কা বাড়িয়ে এক ঝটকায় ও উঠে দাঁড়ায় । ঘটনার আকস্মিকতায় মুখ থেকে বের হয় আর্তচিৎকার । চেপে ধরি মুখ-ঢেকে ফেলি চোখ । মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় কেউ চিৎকার শুনতে পায় না-না পাওয়াতে রক্ষা হয় আমার । চোখের জল ও বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে ওর দিকেই চোখ থাকে না । বৃষ্টির চেয়েও তীব্র ধারায় বের হয় চোখের জল । চোখের উপর থেকে হাত সরালেই দেখি ও নেমে আসছে । পরীক্ষণ পদ্ধতির সফলতায় আমি ভাসতে থাকি- আমি উড়তে থাকি ।

সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিচে নেমে ও বৃষ্টিতে ডুবে যায় ...।

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর