thereport24.com
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল 24, ৫ বৈশাখ ১৪৩১,  ১০ শাওয়াল 1445

বিড়ি কারখানায় শ্রমিকের অর্ধেকই শিশু

২০১৭ জুন ১২ ২০:৫২:৪৩
বিড়ি কারখানায় শ্রমিকের অর্ধেকই শিশু

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তা সত্বেও দেশের বিভিন্ন বিড়ি কারখানায় বর্তমানে প্রায় ৪২ হাজার ৫০০ শিশু ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে। যা মোট বিড়ি শ্রমিকের প্রায় অর্ধেক। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিড়ি উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে তারা কাজ করছে, যাদের অধিকাংশের বয়স ৪ থেকে ১২ বছর। আর এসব শিশু প্রতিনিয়তই সর্দি-কাশি, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, হাত-পা ব্যথা, ব্রঙ্কাইটিস ও এজমা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা প্রজ্ঞার টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিমের সরেজমিন বিড়ি কারখানা পরিদর্শনে শিশুশ্রমের এ ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে মোট ১৯৫টি বিড়ি কারখানায় ৬৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার ৫০০ শিশু শ্রমিক রয়েছে। এসব কারখানায় প্রতি মাসে ৪০৫ কোটি ও বাৎসরিক ৪ হাজার ৮৬২ কোটি শলাকা বিড়ি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রংপুরের হারাগাছয় বর্তমানে প্রায় ৩৫টি (যা দেশের মোট বিড়ি কারখানার প্রায় ৩০%) বিড়ি কারখানা চালু রয়েছে। এসব বিড়ি কারখানায় কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে ২০ হাজারই (৫০%) শিশু। এদের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নিয়মিত অথবা অনিয়মিতভাবে স্কুলে যায়, বাকিরা কখনই স্কুলে যায় না। একইভাবে লালমনিরহাট জেলার ৯টি বিড়ি কারখানায় (যা দেশের মোট বিড়ি কারখানার প্রায় ৭.৭%) প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। যাদের প্রায় ৭০ শতাংশই (১৪,৭০০) শিশু। বিড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত অধিকাংশ শিশুর বয়স ৪ থেকে ১২ বছর।

কারখানাগুলোতে শিশুরা সাধারণত বিড়ির খালি ঠোস তৈরি, খালি ঠোসে গুঁড়া তামাক ভরা, তামাক ভরা ঠোসের মাথা মোড়ানো এবং বিড়ির প্যাকেট তৈরি করে থাকে। এসব কাজের মধ্যে ঠোস তৈরির কাজ গৃহস্থালি পর্যায়ে এবং বাদবাকি কাজ কারখানাতে সম্পন্ন হয়। প্রতি হাজার ঠোস তৈরির মজুরি গড়ে ৭.৫০ টাকা। কারখানায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একজন শিশু গড়ে ৪-৫ হাজার বিড়ির মুখ মোড়ানোর কাজ করে বলে সরেজমিন বিড়ি কারখানাগুলো পরিদর্শনে দেখা গেছে।

সংস্থাটির গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রায় সব শিশুই প্রথমে পারিবারিক শ্রমের অংশ হিসেবে ঘরে বসে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বিড়ির ঠোস তৈরি করে। তারপর একদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে বিড়ি ফ্যাক্টরিতে কাজে ঢুকে পড়ে। বিড়ি তৈরির কাজে একবার জড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে অন্যত্র কর্মসংস্থানে চলে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।

এক পর্যায়ে বেশিরভাগ শিশুই তামাক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আর বছরের পর বছর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করা, তামাক সেবন এবং প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাবে বেশিরভাগ শিশুই মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগে। ফলে তাদের নানারকম অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়। এর মধ্যে ঘনঘন জ্বরে আক্রান্ত হওয়া এবং সর্দি-কাশি প্রায় নিয়মিতই লেগে থাকে। এর কিছুদিন পরই তারা মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, পেট ব্যথা, হাত-পা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, ব্রঙ্কাইটিস ও এজমার মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।

গবেষণায় উঠে এসেছে, রংপুরের হারাগাছ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী আসে তার অর্ধেকই এজমা আক্রান্ত। এর মধ্যে এজমা রোগীদের বেশির ভাগই বিড়ি কারখানায় কাজ করে। রোগীদের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নারী, ১০ ভাগ শিশু এবং ১০ ভাগ পুরুষ। এসব শিশুর মাসে গড়ে চিকিৎসা বাবদ ৩০-৪০ টাকা খরচ হয়।

শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে কথা বলা হলেও দেশে তা পরিপালন করা হচ্ছে না। ওই সনদের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। তালিকার চতুর্থ নম্বরেই রয়েছে বিড়ি ও সিগারেট কারখানার কাজ। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন নং ১৮২ অনুসমর্থন করেছে। শিশু অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত এসব বিধি-বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিড়ি কারখানার মালিকেরা ঝুঁকিপূর্ণ তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিড়ি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে শিশুশ্রম ব্যবহার করছে।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশু অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ শিশুর স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদের আশঙ্কা আছে এমন সব কাজে যেন শিশুদের ব্যবহার করা না হয় তার ব্যবস্থা নেবে।’

এ বিষয়ে প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশে শিশু শ্রমিকদের আয়-রোজগারের চিত্র খুবই ভয়াবহ এবং অমানবিক। বিগত কয়েক দশকে প্রায় সবধরনের শ্রমজীবী মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। বরং প্রকৃত মজুরির মূল্যমানে তা খানিকটা হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে। ফলে খানাগুলি ক্রমবর্ধমান আয় ঘাটতির চাপ সামলাতে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে সংসারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই বিড়ির কারখানায় কাজ করছে শিশুরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘মূলত শিশু শ্রমিকরা বাবা-মার কাজে সহযোগিতা করতে করতেই বিড়ি শ্রমিক হয়ে ওঠে। প্রথমে পারিবারিক শ্রমের অংশ হিসেবে ঘরে বসে অন্যান্য সদস্যদের সাথে বিড়ির ঠোস তৈরি করে তারপর একদিন বাবা-মায়ের হাত ধরে বিড়ি ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়ে। বিড়ি কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ কিন্তু সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় তামাক কোম্পানির বিপণন কৌশলে প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তবে পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন এই অমানবিক শ্রম বন্ধ হোক এটাই টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ওয়াচবিডি টিমের প্রত্যাশা।’

উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস সোমবার (১২ জুন) পালিত হয়েছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- দ্বন্দ্ব ও বিপর্যয়ের মধ্যে শিশু মজুরি থেকে শিশুদের রক্ষা করুন। শিশু অধিকার সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম প্রতিরোধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবছর ১২ জুন দিবসটি পালন করে আসছে।

(দ্য রিপোর্ট/এনটি/এনআই/জুন ১২, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর