thereport24.com
ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল 24, ৬ বৈশাখ ১৪৩১,  ১১ শাওয়াল 1445

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা

৩ জঙ্গি গ্রেফতার হলেই গুলশান হামলার তদন্ত শেষ

২০১৭ জুন ৩০ ১৯:১৩:৩৯
৩ জঙ্গি গ্রেফতার হলেই গুলশান হামলার তদন্ত শেষ

মো. শামীম রিজভী, দ্য রিপোর্ট : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া আরও পাঁচজনের মধ্যে দুই-একজনকে গ্রেফতার করতে পারলেই মামলার তদন্ত কাজ শেষ। এদের মধ্যে সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেটকে ধরতে পারলেই তদন্তকাজ শেষ করা যাবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোঁরায় জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ২ জন পুলিশ ছাড়াও জিম্মি ২০ দেশি-বিদেশিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২০ জিম্মির মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি। পরদিন ভোরে সেনা বাহিনীর অভিযানে ৫ জঙ্গিও নিহত হয়।

এ ঘটনার এক বছরে ভিকটিমদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেলেও, হামলাকারীদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখন পর্যন্ত হাতে পায়নি তদন্ত কর্মকর্তারা। মামলাটি এখন তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটি ইউনিট। সিটি ইউনিটের পাশাপাশি অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরাও ছায়া তদন্ত করছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলায় ভিকটিম যারা মারা গিয়েছে গত ১৯ জুন আমরা তাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। হামলাকারীদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। এই মামলার তদন্তে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রিপোর্ট পাওয়ার পরই তদন্তকাজ শেষ করতে পারব। এছাড়া যে পলাতক যে পাঁচজনকে খুঁজছি তাদের মধ্যে তিনজন এই মামলার তদন্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসামি। তাদের খুব বড় ধরণের ভূমিকা ছিল হামলার পরিকল্পনা ও এটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে। তারা হলেন— সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেট। তাদের ধরতে পারলেই তদন্তকাজ শেষ করতে পারব। মামলার তদন্তকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। অবশিষ্ট পাঁচজনকে অথবা তাদের মধ্যে দুই একজনকে গ্রেফতার করতে পারলেই তদন্তকাজ শেষ করে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করার চেষ্টা করবে।’

পলাতক সোহেল মাহফুজ

গুলশান হামলার আরও আগে থেকেই জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত ছিল সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা সোহেল ওরফে নাসিরুদ্দিন ওরফে ভাগিনা সোহেল। সে জেএমবির পুরনো ধারার একজন শীর্ষ সদস্য। সে গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড সরবরাহ করেছে। ‘নিউ জেএমবি’ নামে জঙ্গিদের যে নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে, এই তৎপরতার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে।

জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শুরা সদস্য হিসেবে নাম ছিল সোহেল মাহফুজের। ২০১০ সালে নিষিদ্ধ সংগঠনটির আমীর সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর সে নিজেকে আমীর হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু কারাগারে থেকেও সাইদুর আমিরের পদ ছাড়তে না চাওয়ায় তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। পলাতক সোহেল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে আত্মগোপনে থেকেও জেএমবির নতুন একটি গ্রুপ তৈরি করে। সে দেশে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। সোহেল মাহফুজ গুলশান হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের ঘনিষ্ঠ। নিহত তামিম চৌধুরী গ্রেনেড ও অস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়ে সোহেল মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বোমা তৈরি করতে গিয়ে সোহেলের বাম হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে এক হাত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারে। জেএমবির এ নেতার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়।

রাশেদ ওরফে র‌্যাশও পলাতক

গুলশানের ঘটনার তদন্তে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ নামের এক জঙ্গির তথ্য পাওয়া গেছে। আজিমপুরে অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম কাদেরী ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এ নামটি জানায়। তাহরীমদের বাসায় যাতায়াত ছিল রাশেদ ওরফে র‌্যাশের। উত্তরার বাসায় জাহিদের সঙ্গে রাশেদ আসত।

বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটেরও সন্ধান নেই

এই নিষিদ্ধ সংগঠনটির অন্যতম শীরষস্থানীয় নেতা মারজান জীবিত থাকার সময়ে তার নির্দেশেই দায়িত্ব পালন করত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বাসারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার ওরফে রাহুল ওরফে চকলেট। সংগঠনে নানা যোগাযোগ তদারকের পাশাপাশি গুলশান হামলার আগে নব্য জেএমবির কাছে বিদেশ থেকে আসা টাকা গ্রহণ ও বণ্টন করেছিল সে। অস্ত্র সংগ্রহেও ছিল তার ভূমিকা। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, মারজান নিহত হওয়ায় চকলেটকে এসব দায়িত্ব এখন একাই পালন করতে হচ্ছে। স্ত্রী ফেরদৌসী আফরিনকে নিয়ে বাসারুজ্জামান আমেরিকায় রয়েছে বলে স্বজনরা জানালেও গত সেপ্টেম্বরে আজিমপুরের আস্তানা থেকে তার স্ত্রীকে গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে আসল ব্যাপার।

জানা যায়, ওই দম্পতি দেশে থেকেই জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। নতুন জঙ্গিদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত সংগঠনের আইটি-বিষয়ক কাজগুলোও তদারক করে চকলেট। গুলশান হামলায় জঙ্গিদের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে আসা ১৪ লাখ টাকার একটি চালান চকলেটের কাছে আসে।

নব্য জেএমবিকে সক্রিয় রাখছে মুসা

এ ছাড়াও তদন্ত শেষ করতে মুসা নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করা জরুরি বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। রাজধানীর আশকোনা অভিযানের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কপালে নতুন করে ভাঁজ সৃষ্টি করে সুইসাইডাল স্কোয়াড প্রধান মইনুল ইসলাম ওরফে আবু মুসা। গত ২৩ ডিসেম্বর আশকোনায় মুসার আস্তানায় অভিযান চালানো হলে তার স্ত্রী তৃষামনি ওরফে উম্মে আয়েশা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সে পুলিশকে জানিয়েছে, সুসাইডাল স্কোয়াডের পুরো তত্ত্বাবধানকারী হলো মুসা। অস্ত্র চালনা এবং বোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত এই ভয়ঙ্কর মুসা সংগঠিত করছে নব্য জেএমবির অন্য সদস্যদের। রাজধানীতেই ছিল তার বেশ কয়েকটি আস্তানা। এ সব আস্তানা কোন কোন এলাকায় তা নিশ্চিত হলেও সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। পলাতক মুসাই এখন নব্য জেএমবিকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জবানবন্দিতে নব্য জেএমবির নেতা তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম জানায়- পল্লবীর বাসায় থাকা অবস্থায় চকলেট, মুসা আর র‌্যাশ আসত। র‌্যাশ ওই বাসায় চকলেট ও কল্যাণপুরে নিহত আকিফুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মুসা আংকেলের বয়স ৩৮ বছরের মতো। মুখে দাড়ি, স্বাস্থ্য মাঝারি, দেখতে শ্যামলা। সে শার্ট-প্যান্ট পরে। মুসা আংকেল কখনো একা আসত আবার কখনো চকলেট ও র‌্যাশ সঙ্গে থাকত। জিহাদ, ইমান নিয়ে কথা বলত। সিরিয়ায় যুদ্ধের ভিডিও দিত। আমরা তা দেখতাম। দাবিক ম্যাগাজিন পড়তে দিত। এই ম্যাগাজিন কয়েকটা বাংলায় ছিল। চকলেট ও র‌্যাশের কথামতো গত রমজান মাসে তার বাবা বারিধারায় একটি বাসা নেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মামলটির তদন্ত করছে সিটি ইউনিট। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা গত এক বছরে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ওই ঘটনায় সরাসরি যারা জড়িত ছিল অর্থাৎ যারা হামলা করেছিল তারা সবাই ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। এর বাইরে ওই ঘটনার পরিকল্পনা, সহযোগিতা করা বা নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে এ রকম অনেককে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম। তাদের মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত ছিল এ রকম আটজন গত এক বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার আছে চারজন, তাদের মধ্যে তিনজন নিজেদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। আর আমরা এখনো পাঁচজনকে খুঁজছি, তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।’

এদিকে হলি আর্টিজানসহ নব্য জেএমবি’র কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কয়েক কোটি টাকার তহবিল গড়েছিলেন পুরো পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় পলাতক ডা. খন্দকার রোকনউদ্দিন নামে একজন চিকিৎসক। এ তহবিল গড়তে তার সঙ্গে ছিল মিরপুরের রূপনগরে নিহত জাহিদুল ইসলাম ও আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদেরী। সপরিবারে সিরিয়ায় পালানোর আগে রোকনুজ্জামান নব্য জেএমবি’র তহবিলে জমা দেন ৮০ লাখ টাকা। তাদের এ তহবিল গুলশান হামলায়ও ব্যবহার করা হয়, কেনা হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ। ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকনুদ্দীন (৫০) খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় থাকতেন। তার স্ত্রী নাইমা আক্তার (৪৫) যশোর সরকারী এম এম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং কবি নজরুল কলেজের অধ্যাপক। তাদের সঙ্গে তাদের দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন (২৩) ও রামিতা রোকন (১৫) এবং জামাতা সাদ কায়েস (২৬)। রেজওয়ানা ও সাদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং রামিতা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। গত এক বছর ধরে তারা নিখোঁজ। পুলিশের ধারণা, তারা সিরিয়া হয়ে আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ডা. রোকনউদ্দিন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা বাস্তবায়নে জেএমবির তহবিলে ৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে এ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। জেএমবির তহবিলে টাকা দিয়ে ডা. রোকনউদ্দিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। গত ১৮ জুলাই রাজধানীর খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক রোকনউদ্দিন তার পরিবারসহ নিখোঁজ হন।

সিটি ইউনিটের প্রধান বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আমরা হিসাব করে দেখেছি হামলাকারীরা যেসব অস্ত্র বিস্ফোরক ও অপারেশনাল সামগ্রী হামলার কাজে ব্যবহার করেছে সেগুলো সংগ্রহ করতে খুব বেশি খরচ হয়নি। আট নয় লাখ টাকার বেশি তাদের এই অপারেশনের জন্য খরচ হয়নি। ওই বছর আর্থিকভাবে সচ্ছল বেশ কয়েকজন তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল। যাদের একজন আজিমপুরে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরী, যার ভাড়া করা বাসাতেই হামলাকারীরা অবস্থান করেছিল। তানভীর কাদেরী একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতো। তার স্ত্রীও একটা মাল্টিন্যাশনাল এনজিওতে চাকরি করতো। তারা কিন্তু কথিত হিজরতের আগে তাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করেছে, গাড়ি বিক্রি করেছে এবং এই টাকা তারা নব্য জেএমবির ফান্ডে দিয়েছে। সুতরাং হামলার জন্য আট নয় লাখ টাকা জোগাড় করতে তাদের তেমন কোন সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।’

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘হাসনাত করিম এখনও এই মামলার সাসপেক্টেড আসামি। সে কারণেই তাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং এখন সে কারাগারে আছেন।’

তদন্ত শেষেই তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আমরা জানাতে পারবো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

(দ্য রিপোর্ট/এমএসআর/আরএমএম/এনআই/জুন ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

M

M

SMS Alert

এর সর্বশেষ খবর

- এর সব খবর